ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজামীকে মন্ত্রী করা ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গালে কষে চড়

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ৩০ অক্টোবর ২০১৪

নিজামীকে মন্ত্রী করা ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গালে কষে চড়

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে বাংলাদেশের মন্ত্রী করাটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গালে চড় দেয়ার শামিল। বুধবার যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদ- দিয়ে দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে এ কথা বলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এদিকে, নিজামীর যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য-জেরা শেষে চূড়ান্ত রায় ঘোষণায় প্রায় এক বছর বিলম্বের বিষয়ে আপোস হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আসা বক্তব্যের জবাব দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, আমরা আপোস এবং সমঝোতা করি না। তা করলে আইন ও সংবিধানের জন্যই করি। আমাদের কেউ নির্দেশও দেয় না। আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি, আইন ও সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হই। বুধবার এ মামলার বহু প্রতীক্ষিত রায় পড়া শুরুর আগেই এ মন্তব্য দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, নিজামী মনপ্রাণ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেননি, তিনি পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী, আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবিরের হত্যাকা-ের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। অথচ এই নিজামীকেই বাংলাদেশের মন্ত্রী করা হয়েছিল, যা ছিল বড় ধরনের ভুল এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গালে কষে চড়। পর্যবেক্ষণে আলবদর বাহিনী সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল বলেন, নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলেন না, এটি গঠনের ক্ষেত্রেও মূল হোতা ছিলেন। এ ছাড়া ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন, যা বর্তমানে ছাত্রশিবির নামে পরিচিত। আলবদর বাহিনী ছিল ছাত্রসংঘের ‘এ্যাকশন সেকশন’। স্পষ্টতই ছাত্রসংঘ ও আলবদরের ওপরে নিজামীর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, নিজামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১১ থেকে ১৪ নম্বর অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভায় পাকিস্তানকে ‘আল্লাহর ঘর’ বলেন। স্পষ্টতই তিনি এবং তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী ইসলামের মূল কথার বিকৃতি ঘটিয়ে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, আলবদর একটি ক্রিমিনাল সংগঠন তো বটেই, একই সঙ্গে এটি একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনও। সে সময় ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রচুর তরুণকে এ সংগঠনটি বিভ্রান্ত করেছিল, যাদের নেতা ছিলেন নিজামী। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০১ সালে সরকার গঠনের সময় মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন নিজামীকে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ওই সরকারে পাবনা-১ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য নিজামীকে প্রথমে কৃষিমন্ত্রী করা হয়েছিল। পরে তিন বছর শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে জামায়াত এখনও রয়েছে। তবে জোট শরিক দলের আমিরের মৃত্যুদ- নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি তারা। একাত্তরে আলবদর বাহিনীর প্রধান নিজামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গোলাম আযমের মতোই পালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর পালাবদলে ক্ষমতায় যাওয়া জিয়ার অনুমতি নিয়ে ১৯৭৮ সালে নিজামী বাংলাদেশে ফেরেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের পূর্বসূরি সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান নিজামী দেশে ফেরার পর প্রথমে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর আমিরের দায়িত্ব নেন। এরপর সহকারী জেনারেল থেকে সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি। ২০০০ সাল থেকে দলটির আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ট্রাইব্যুনাল আপোস করে না ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, আমরা আপোস এবং সমঝোতা করি না। তা করলে আইন ও সংবিধানের জন্যই করি। আমাদের কেউ নির্দেশও দেয় না। আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি, আইন ও সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হই। নিজামীর রায় ঘোষণা শুরুর আগে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন এ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। আমরাও অপেক্ষা করেছি এই ভারডিক্ট কবে দিতে পারব। এ অপেক্ষার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহল ও গণমাধ্যমে নানা কথা উঠে এসেছে। কিন্তু এসব কথা আমাদের আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। আমরা এর জবাব দিতে পারি না, জবাব দেয়া উচিতও হবে না। তবে একটি কথা বলতে চাই- ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের মূল কথা হলো, না শুনে বিচার করা যায় না। ট্রাইব্যুনাল সব সময়ই আইন ও সংবিধান মেনে চলার চেষ্টা করে। আইন পর্যালোচনা করে আমরা রায় দেই। আমাদের ওপর কারও কোন নির্দেশ নেই। আমরা বলতে গেলে বোবার মতো থাকি। টক শোতে বা গণমাধ্যমে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত আমরা কোন জবাব দিতে পারি না।’ ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পর ২০৪ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি মোঃ আনোয়ারুল হক। এরপর ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশ পড়েন। সবশেষে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
×