ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সর্বোচ্চ আদালতেও রায় বহাল ॥ বদর জল্লাদের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৪ নভেম্বর ২০১৪

সর্বোচ্চ আদালতেও রায় বহাল ॥ বদর জল্লাদের ফাঁসি

০ সোহাগপুরের গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের অপরাধে ট্রাইব্যুনালে দেয়া কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় আপীল বিভাগে বহাল ০ রায় কার্যকর কারাবিধি অনুযায়ীই হবে আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সোহাগপুর গণহত্যার খলনায়ক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ই বহাল রেখেছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। উচ্চ আদালতের এ চূড়ান্ত রায়ের ফলে ফাঁসিরকাষ্ঠেই যেতে হবে এই হত্যাকারী-ধর্ষককে। সোমবার আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপীল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ মৃত্যুদ-ের রায় দেন। বেঞ্চের অন্য তিন বিচারপতি হলেন- বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। গত বছরের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে থাকা তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে আপীল বিভাগের চার বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে আসামি কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তবে মৃত্যুদ-ের বিষয়ে চার সদস্যের বেঞ্চে একজন বিচারপতি দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের দ্বিতীয় মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো। এদিকে, সুপ্রীমকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন (পুনর্বিবেচনার আবেদন) করা যাবে কিনা, এ নিয়ে দুই পক্ষ আবারও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ নেই। অন্যদিকে, জামায়াত নেতাদের আইনজীবী এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করার পর তারা রিভিউ আবেদন দায়ের করবেন। এর আগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ- দিয়ে সুপ্রীমকোর্ট রায় দেয়ার পরও একই ধরনের বিতর্ক উঠেছিল। পরে কাদের মোল্লার আইনজীবীরা রিভিউ আবেদন দায়ের করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। আইনজ্ঞরা বলছেন, এখন কাদের মোল্লা রিভিউ সংক্রান্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের পরই বোঝা যাবে রিভিউর সুযোগ রয়েছে কি নেই। সোমবার সকাল নয়টা ১০ মিনিটে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে রায় ঘোষণা শুরু করেন আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহা। তিন মিনিটের মধ্যেই সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শেষ হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলে, ‘এই আপীলের আংশিক মঞ্জুর করা হলো। আপীল দায়েরকারী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে তার বিরুদ্ধে থাকা ১ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। ২ এবং ৭ নম্বর অভিযোগে তার কারাদ- সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে বহাল রয়েছে। ৩ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। ৪ নম্বর অভিযোগে তার মৃত্যুদ- থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলো।’ এছাড়া ট্রাইব্যুনালে খালাস পাওয়া ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে কোন আদেশ দেয়নি সুপ্রীমকোর্ট। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ ইকরামুল হক টুটুল, ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও তুরিন আফরোজ। অন্যদিকে আসামি পক্ষে এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় বিশিষ্টজনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান আরীফ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান । গত বছরের ৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগগুলোর মধ্যে ১, ২, ৩, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত এবং ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। এ দু’টি অভিযোগ করা হয়েছে যথাক্রমে সোহাগপুর গণহত্যা ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে। ১ (বদিউজ্জামান হত্যা) ও ৭ (দারাসহ ছয় হত্যা) নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে (অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতন) ১০ বছরের কারাদ-াদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আর প্রমাণিত না হওয়া অন্য দুই অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১, ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেয়া ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে গত বছরের ৬ জুন আপীল করেন কামারুজ্জামান। ২৯ সেপ্টেম্বর আপীলের সারসংক্ষেপ জমা দেন আসামিপক্ষ। ১২৪টি যুক্তিতে আপীল করে আসামিপক্ষ। তাদের মূল আবেদন ১০৫ পৃষ্ঠার। আর এর সঙ্গে দুই হাজার পাঁচশ’ ৬৪ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দেয়া হয়। গত ৫ জুন থেকে শুরু হয় এ আপীল শুনানি। ৫ জুন থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ১৫ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান ও এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে রাষ্ট্রপক্ষে ৪ কার্যদিবস শুনানি করেছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সমাপনি বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় কামারুজ্জামানের বিচারিক কার্যক্রম। পরে ওই দিনই সুপ্রীমকোর্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ঘোষণা করে (সিএভি)। প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন নিজে এ আপীল মামলার শুনানিতে না থেকে বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের পৃথক আপীল বেঞ্চ গঠন করে দেন। এর আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে দ-প্রাপ্ত অপর দুই জামায়াত নেতা সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপীল মামলার শুনানি হয়েছে প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার আপীল শুনানির চূড়ান্ত রায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ বাড়িয়ে মৃত্যুদ-াদেশ দেয় আপীল বিভাগ। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সে রায় কার্যকর করা হয়েছে। অন্যদিকে সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ-াদেশ কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদ-াদেশ দিয়েছে আপীল বিভাগ। তার আপীল মামলার শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল মামলার চূড়ান্ত রায় অপেক্ষমাণ রাখে আপীল বিভাগ। রায় কার্যকর প্রক্রিয়া ॥ ট্রাইব্যুনাল থেকে কোন আসামিকে মৃত্যুদ- দেয়ার পর সাধারণত সবাই ভাবেন, এখনই তা কার্যকর হচ্ছে না। কারণ আপীল বিভাগ তো রয়েছে। কিন্তু আপীল বিভাগেও মৃত্যুদ- হলে তখন সবার একটাই প্রশ্ন থাকে, এ রায়ের কার্যকর কিভাবে হবে। একইভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানকে আপীল বিভাগও মৃত্যুদ- দেয়ার পর সেই প্রশ্ন জনমনে ঘোরপাক খাচ্ছে। উত্তরে বলা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকরের ক্ষমতা এখন সরকারের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনের ২০ (৩) ধারা সরকারের এই ক্ষমতা নিশ্চিত করেছে। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদ- বহাল রাখায় নিয়ম অনুযায়ী এখন সরকারের নির্দেশনায় কারা কর্তৃপক্ষ দ- কার্যকর করবে। একই মত দিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, রায়ের কপি কারাগারে গেলেই সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষ দ- কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আরও বলেন, সংক্ষিপ্ত আদেশের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু পাইনি। আদালত বলেছে, বিষয়টি দেখবে। সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে বিচার হওয়ায় রিভিউসহ প্রচলিত আইনের বিধিবিধান এখানে কার্যকর হবে না। আইনজ্ঞরা বলছেন, এর আগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- রিভিউয়ের আবেদন জানানো হলেও প্রথম সুযোগেই তা খারিজ করে দেয় আদালত। ওই ঘটনা প্রমাণ করে এক্ষেত্রে রিভিউয়ের সুযোগ নেই। যদিও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে কিনা, তা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। আসামি পক্ষ বলছে, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের রিভিউ করার অধিকার রয়েছে। তবে সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য ওই অধিকার বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যেকোন বিধি সাপেক্ষে আপীল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকবে।’ আবার সংবিধানের ৪৭ক-এর (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হয়েছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীমকোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’ ৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বলা হয়েছে, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য (বা অন্য কোন ব্যক্তি, ব্যক্তিসমষ্টি বা সংগঠন) কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দ-দান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বা তার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলে গণ্য হবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হয়েছে বলে গণ্য হবে না। রায় কার্যকর করতে নিয়মানুযায়ী, আপীল আদালতের রায় ও আদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানোর পর ট্রাইব্যুনাল আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। ওই পরোয়ানা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারাগারে পাঠাতে হবে। কারাকর্তৃপক্ষ বিষয়টি দ-প্রাপ্ত আসামিকে পড়ে শোনাবে। কারা বিধির ৯৯১ ধারার ৩ উপবিধিতে বলা হয়েছে, দ-প্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন। তবে সাত দিনের মধ্যে ক্ষমার আবেদন করতে হবে। ৫ উপবিধিতে বলা হয়েছে, সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন না করলেও পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২১ দিনের মধ্যে যেকোন দিন রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার সুযোগ পাবেন আসামি। এরপর রাষ্ট্রপতির নেয়া সিদ্ধান্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত কারাকর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে না। কারাবিধির ৯৯১তে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কারাকর্তৃপক্ষ আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করবে। ফল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই আবার কারাকর্তৃপক্ষকে জানাবে। তবে আসামি যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি না থাকে তাহলে যে কোন দিনই দ- কার্যকর করা যাবে। আইনজ্ঞরা বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সরকার চাইলে যে কোনভাবেই দ- কার্যকর করতে পারবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনের ২০ (৩) ধারা সরকারকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার চাইলে জেলকোড অনুসরণ না করেও দ- কার্যকর করতে পারবে। সাত অভিযোগে আপীল বিভাগের রায় ॥ একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ সাতটি অভিযোগ এনেছে। অভিযোগগুলো হলোÑ ১ নম্বর অভিযোগ ॥ ২৯ জুন ১৯৭১ সাল, রাত ১১টার দিকে শেরপুর জেলার নলিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামের মোঃ ফজলুল হকের পুত্র শহীদ বদিউজ্জামানকে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। আহম্মদনগর ক্যাম্পে সারারাত নির্যাতন করে পরের দিন আহম্মদনগর রাস্তার ওপর গুলি করে হত্যা করা হয়। লাশ টেনে নিয়ে কাছে কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেয়। মোহাম্মদ কামারুজ্জামান আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে সব সময় সেনাবাহিনীর সাথে জিপে করে ওই ক্যাম্পে আসা-যাওয়া করত। এলাকায় পরিকল্পিতভাবে হত্যাকা- সংঘটিত করত। এ অভিযোগ থেকে আপীল বিভাগ কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছেন। ২ নম্বর অভিযোগ ॥ একাত্তরে মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা। এ অভিযোগে নিম্ন আদালতের দেয়া ১০ বছর কারাদ- বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। ৩ নম্বর অভিযোগ॥ আসামির পরিকল্পনায় ও পরামর্শে একাত্তরে ২৫ জুলাই ভোরে রাজাকার, আলবদরসহ সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষ লোকদের হত্যা করে এবং মহিলাদের ধর্ষণ করে। ঘটনার দিন থেকে ওই গ্রাম বিধবা পল্লী নামে সর্বমহলে পরিচিত। সে দিন ওই গ্রামে ১২০ জনকে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগে আপীল বিভাগের চার বিচারপতিই কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন। ৪ নম্বর অভিযোগ ॥ ১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায়। কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর বাহিনীর লোকজন তাকে ধরে নিয়ে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তার চাচা তোফায়েল ইসলাম আসামি কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করে তাকে ছাড়িয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। ওই রাতেই কামারুজ্জামান ও তার আলবদর বাহিনী গোলাম মোস্তাফা ও আবুল কাশেম নামে অপর একজনকে মৃগি নদীর ওপর শেরী ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গোলাম মোস্তফা মারা যায়। কিন্তু আবুল কাশেম হাতের আঙুলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ- দিলেও আপীল বিভাগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে। ৫ নম্বর অভিযোগ ॥ একাত্তরের রমজান মাসের মাঝামাঝি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শেরপুরের চকবাজারের বাসা থেকে মোঃ লিয়াকত আলী, পিতা মোঃ সাদেক আলী মিয়া এবং মজিবুর রহমান জানু, পিতা মৃত আঃ আজিজ খান উভয় সাং- চকবাজর, থানা+জেলা- শেরপুর। আসামি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ৪-৫ জন তাদের বাসা থেকে ধরে রঘুনাথ বাজারের বানথিয়া বিল্ডিংয়ে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সেখানে তাদের ৪ দিন আটক রাখার পর আসামি কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাদেরসহ অন্তত ১১ জনকে ঝিনাইগাতী আহম্মদনগর আর্মি ক্যাম্পে চালান দেয়। তাদের সকলকে আহম্মদনগর ইউপি অফিসের পেছনে একটি গর্তের পাশে দাঁড় করায়। তাকেসহ তিনজনকে ওই লাইনে থেকে আলাদ করে বাকিদের গুলি করে হত্যা করে। গুলি করার সময় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিল। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছিল। আপীল বিভাগ সংক্ষিপ্ত রায়ে এ বিষয়ে কোন আদেশ দেয়নি। ৬ নম্বর অভিযোগ ॥ একাত্তরের নবেম্বর মাসে দিদারসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহ শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে সেখানে নির্যাতন চলে তাদের ওপর। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছিল। আপীল বিভাগ সংক্ষিপ্ত রায়ে এ বিষয়ে কোন আদেশ দেয়নি। ৭ নম্বর অভিযোগ : একাত্তরে ২৭ রোজার দিন দুপুরে টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়াসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়। টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জাহিরুল ইসলাম দারাকে আলবদর বাহিনী ধরে আনে। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট চার্জ করা হয়। পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিবরণ অনুযায়ী, কামারুজ্জামান এসব অপরাধ করেছেন একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে। তার বিচরণক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে ১০ বছর কারাদ- দিয়েছিল। আপীল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের রায়টিই বহাল রেখেছে। কে এই কামারুজ্জামান? ॥ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন। তাঁর বাবা ইনসান আলী সরকার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র কামারুজ্জামান ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। জামালপুরে আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষকে হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে। স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান। ১৯৮২-৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন।
×