ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই আর খালেদা জিয়ার!

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৪ নভেম্বর ২০১৪

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই আর খালেদা জিয়ার!

একি কথাÑ ক্ষমতায় যাওয়ার এত বড় শখ তিরোহিত মোয়াজ্জেমুল হক ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নাটোরের এক জনসভায় আকস্মিক ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই। শুধু দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করতে চান। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ঘরে ফিরে যাবেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নব্য হিটলার এবং তাঁর মাথায় গ-গোল আছে। গ-গোল থাকলে দেশ চালানো যায় না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘শখ’ হারিয়ে যাওয়া, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ‘নব্য হিটলার’ ও তাঁর ‘মাথায় গ-গোল’ থাকার এ তিনটি শব্দ বেগম খালেদা জিয়ার মুখ থেকে সম্পূর্ণ নতুন এসেছে। সঙ্গতকারণে শনিবার টিভি চ্যানেলগুলোতে এবং রবিবার সংবাদপত্রগুলোতে প্রচারের পর তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বেগম জিয়ার নতুন এই তিনটি শব্দ আকর্ষণের হলেও বিশ্বাস করার মতো যে নয়Ñ তা সর্বমহলে স্বীকৃত। কিন্তু তারপরও তিনি বলেছেন। অতীতেও তিনি এ জাতীয় মুখরোচক অথচ উদ্ভট বেশকিছু কথা বলেছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, মুসলিম নারীদের সিঁদুর দিতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারতের অধীনে চলে যাবে। সেখানে যেতে বাংলাদেশীদের পাসপোর্ট নিতে হবে। পরবর্তীতে তাঁর এ সব কথা অন্তঃসারশূন্য হিসেবে পরিণত হয়েছে। তারপরও সাধারণ মানুষের মনে জিজ্ঞাসাটি রয়ে গেছে এ জাতীয় কথা দেশের শীর্ষ একজন রাজনীতিক হয়ে কিভাবে বলতে পারলেন। এবার নতুন করে তিনি জানান দিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই। আরও বললেন, শেখ হাসিনার মাথায় গ-গোল আছে এবং তিনি নব্য হিটলার। দেশের রাজনীতি সচেতন মহলে বেগম জিয়ার নতুন এ কথার পর আলোচনায় এসেছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের চলমান বিচার নিয়ে। ইতোমধ্যে একজনের ফাঁকি কার্যকর হয়েছে। বাকি কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে একজনের আপীলের রায় সোমবার ঘোষিত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বিতর্কিত একটিসহ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত এ দলটির ২ জনকে মন্ত্রিত্বও দিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল পুরো বাঙালী জাতির জন্য যেমনি দুর্ভাগ্যজনক, তেমনি অপমানেরও বটে। স্বাধীনতাবিরোধী যে ২ জনকে তিনি দেশের মর্যাদায় জাতীয় পতাকাটিও ধরিয়ে দিয়েছিলেন আর সে পতাকা নিয়ে যখন স্বাধীন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন তখন ৩০ লাখ শহীদের আত্মা নিশ্চয় কেঁদেছে। সম্ভ্রমহারা ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত যেন নতুন করে লুণ্ঠিত হয়েছিল। জাতীয় পতাকা বহনকারী সেই দুই মন্ত্রী নরঘাতক হিসেবে প্রমাণিত হয়ে এখন ফাঁসির আদেশে দ-িত। তাঁরা হলেন জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। সচেতন রাজনৈতিকদের মতে, জামায়াত বিএনপি নেত্রীর পছন্দের দল। তাঁর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় শরিক জোট। বাংলাদেশে এ জামায়াতের নব জন্মদাতা গোলাম আযম মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু দ-াদেশ নিয়ে সম্প্রতি জেলেই মারা গেছেন। আরেক নেতা সাবেক এমপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মৃত্যুদ-াদেশ পেয়েছিলেন। আপীল করে দ-াদেশ কমে আমৃত্যু জেল খাটার আদেশ পেয়েছেন। ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত আরেক নেতা কামারুজ্জামানের আপীলেও ফাঁসি বহাল রয়েছে। জামায়াতের মজলিসে শূরা সদস্য ও অর্থ যোগানদাতা মীর কাশেম আলী ফাঁসির আদেশ পেয়েছেন রবিবার। বেগম জিয়ার দল বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম একই অপরাধে আমৃত্যু কারাদ-াদেশ পেয়ে কারাগারে মারা গেছেন। বিতর্কিত ও বেপরোয়া মনোভাবের আরেক নেতা সাকা চৌধুরীও মৃত্যুদ-াদেশ পেয়ে আপীল লড়াইয়ে লিপ্ত। এছাড়া জামায়াতের অপর তিন নেতা বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁরাও ফাঁসির দ-াদেশ পেয়েছেন। এরা হচ্ছেনÑ আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। শনিবার নাটোরে বেগম জিয়া প্রদত্ত নতুন বক্তব্যের পর ব্যাপকভাবে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যা বলেছেন তাও অন্তঃসারশূন্য। কারণ গণতান্ত্রিক স্বাধীন একটি দেশে নব্য হিটলারের রূপ তিনি কিভাবে খুঁজে পেলেন এবং কারও মাথায় গ-গোল থাকার বিষয়টি তিনি কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে জানতে পারলেন? রাজনীতিতে বেফাঁস কথা বলারও একটা সীমা রয়েছে বলে সচেতন রাজনীতিকরা মনে করেন। এর অন্যথা হলে তাঁরাই তো পাগল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। অথচ তিনি তো সে তালিকার নন। তাহলে প্রশ্ন উঠে কেন এ সব বক্তব্য, যা আবোলতাবোল হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে। বেগম জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী। তাঁর প্রতি দেশের জনগণের একটি অংশের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু জামায়াতীদের সমর্থনে চলে যাওয়ায় সে আস্থায় চিড় ধরে তাঁর আম-ছালা যে দুটোই গেছে, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর মরহুম স্বামী জীবনবাজি রেখে যুদ্ধের ময়দানে বীরের মতো লড়েছেন, আর যারা সে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, পাশাপাশি স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল সেই খুনী চক্রের দলনেতাদের অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর অনেকের রায়ও হয়ে গেছে। কারও কারও আপীল মামলারও নিষ্পত্তি হয়েছে। তাদের দল যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের ঘাতকগোষ্ঠীর বিচারের রায় দেখে তিনি কিছু বলতেও পারছেন না, আবারও সইতেও কি পারছেন না? এ সব যন্ত্রণার বহির্প্রকাশ কি তিনি কাল্পনিক বক্তব্য দিয়ে ঘটালেন? এ প্রশ্ন এখন জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে। রাজনীতি নিয়ে, আন্দোলন নিয়ে, সরকারবিরোধী সমালোচনা নিয়ে বলার অধিকার যেমন সকলের আছে, তেমনি তা সহ্য করার ক্ষমতাও রাজনীতিকদের থাকাটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বেগম জিয়া যে আচরণ রাজনীতির মাঠে প্রদর্শন করে চলেছেন তা একটি শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেত্রীর আচরণ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে তো নয়ই, বরং সর্বত্র হাসির পাত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করছেন বলেই প্রতীয়মান। তাঁর জামায়াতপ্রীতি থাকতে পারে। কিন্তু জামায়াতের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে প্রীতি কখনও থাকতে পারে না। আর একান্ত যদি থেকেই থাকে তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে তাঁর অভিমত প্রকাশ করতে প্রতিবন্ধকতা কোথায়? সে প্রশ্নও উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তাঁর শখ নেইÑএ কথাটি কারও বিশ্বাসে স্থান পাচ্ছে না। কারণ অতীতে তিনবার জয়ী হয়ে তিনি তো তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
×