ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট্ট আবিদ জানে নাÑপাষ- বাবাই তার মা ভাইকে খুন করেছে

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৭ নভেম্বর ২০১৪

ছোট্ট আবিদ জানে নাÑপাষ- বাবাই তার মা ভাইকে খুন করেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এ পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ রইল না ছোট্ট আবিদের। না মা, না বাবা-ভাই। মাত্র দেড় বছর বয়সেই সব হারিয়ে গেল। অথচ মাত্র একদিন আগেও সব ছিল। মায়ের কোলে চড়ে খেলা করত। চুল ধরে টান মেরে মাকে ব্যথা দিয়ে খিলখিল করে হাসত। মা মনে মনে হয়ত রাগও করত, আবার ঠিকই বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করত। চুমু খেত। বলত সোনা বাবা, আবিদ বাবা...আরও কত কি! আব্বা আব্বা আর আম্মা আম্মা করে সারাক্ষণ ডেকে যাচ্ছে আবিদ। অথচ সে জানে না, তার মা-ভাইকে তারই পাষ- পিতা হত্যা করেছে। তারপরও অবুঝ শিশুটি শুধু মা মা বলে ডাকছে। মাঝে মধ্যেই মায়ের কোলে চড়ে আনন্দে দুধ খাওয়ার জন্য হাউমাউ করে কাঁদছে। সে কান্না থামার নয়। তার কান্নার সঙ্গে কাঁদছে শত শত নারী-পুরুষ। মাঝে মধ্যে আব্বা আব্বা বলেও ডাকছে। একেকবার যখন পিতা-মাতাকে ডাকছে তখন সেখানে আর কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না। হাউমাউ করে কাঁদছে সবাই। কান্নার সঙ্গে পাষ- পিতার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করছেন আবেগে আপ্লুতরা। এমন দৃশ্যই দেখা গেছে আবিদের চাচাত নানির বাড়িতে। সেখানেই আশ্রয় জুটেছে ছোট্ট আবিদের। সকাল থেকেই শত শত নারী-পুরুষ মিরপুর থানাধীন মধ্যপাইকপাড়ার আহাম্মদনগরের ৬৭/এ নম্বর বাড়িতে ভিড় করছেন। সেখানে মিনিটে মিনিটে রীতিমতো যানজট হচ্ছে। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে ৬ তলা এ বাড়িটিরই পঞ্চম তলার ৫/সি নম্বর ফ্ল্যাটে লোমহর্ষকভাবে পাষ- পিতা আমানুল্লাহ তার সাত বছর বয়সী বড় ছেলে সাবিদ আর স্ত্রী আইরিন সুলতানা আরজুকে (৩৫) প্রচ- মারধরের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে। সুবর্ণা নামে এক মেয়ের সঙ্গে পরকীয়ার সূত্র ধরে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া চলছিল। বছরখানেক ধরে স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে বসবাস করছিল না ঘাতক আমানুল্লাহ। স্ত্রীকে মারধরের পর হত্যা করে। সেই সময় ঘটনাটি দেখে ফেলে তার বড় ছেলে সাবিদ। সে ঘটনাটি পুলিশকে জানাতে পারে, এমন ভয়ে পুত্রকেও শ্বাসরোধে হত্যা করে নরপিচাশ পিতা। বেঁচে থাকে ছোট ছেলে আবিদ। বুধবার রাতেই আবিদকে তার চাচাত নানির বাড়িতে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা। মধ্যপাইকপাড়ার সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করে আছেন। সবার মুখেই এক কথা। কেমন পাষ-! নিজ পুত্রকে হত্যা করতেও দ্বিধা করল না। হায়রে পরকীয়া। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল ৫ নারীর। তারা পাশের একটি স্কুলের শিক্ষক। তারা বলছেন, অন্তত ছোট্ট শিশুটির জন্য হলেও এমন পাষ-ের মতো হত্যা করা ঠিক হয়নি। তারা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। অনেকেই বলছেন, এমন পুরুষকে এমন শাস্তি দেয়া দরকার, যাতে আর কোন পুরুষ অন্যায়ভাবে এভাবে নিজ সন্তান আর স্ত্রীকে হত্যা না করে। এরপর রওনা হই মধ্যপাইকপাড়ার সেই বাড়িতে। যে বাড়িতে বুধবার রাত থেকেই রাখা হয়েছে বেঁচে যাওয়া আবিদকে। যদিও বাড়িটির ঠিকানা অনেকের কাছেই অজানা। তাই ইচ্ছা করেই বাড়ির ঠিকানা প্রকাশ করা হলো না। এছাড়া বাড়িটির ঠিকানা আবিদের পরিবারের তরফ থেকেও প্রকাশ না করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ অতিরিক্ত লোকজন আবিদকে দেখার জন্য সেই বাড়িতে ভিড় জমালে আবিদের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে বা আবিদের মনের উপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে। আবিদ অনেক সময়ই স্বাভাবিক আচরণ করছে। আবার মাঝে মধ্যেই আম্মা আম্মা আর আব্বা আব্বা করে ডাকছে। তখন উপস্থিত সবাই নীরবে অঝোরে কাঁদছেন। আবিদকে মিথ্যা সান্ত¡না দিচ্ছেন। আম্মা আব্বা ফিরে আসবে। আরও কি যে বলছেন বাড়ির লোকজন তার ইয়াত্তা নেই। অথচ সবই মিথ্যা আশ্বাস। অতটুকুন বাচ্চাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন আত্মীয়স্বজনরা। মাঝে মধ্যেই মায়ের বুকের দুধের জন্য ছটফট করছে। মুখে দুধ দিলে তা ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। আবিদের চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আছে। কি হবে আবিদের ভবিষ্যত। অতটুকুন ছেলেকে কিভাবে মানুষ করবেন। বাঁচিয়ে রাখবেন তাই নিয়ে মহা চিন্তায় তার আত্মীয়স্বজন। এদিকে মা ছেলের লাশ বৃহস্পতিবার বিকেলে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানাধীন হলদে গ্রামে পৌঁছলে শত শত মানুষ ভিড় করেন। মা ছেলেকে এক নজর দেখার পরই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শত শত আবালবৃদ্ধবনিতা। মানুষের আর্তনাদ আর আহাজারিতে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যায়। চারদিকে শুরু হয় শোকের মাতম। বৃহস্পতিবার বিকেলেই হলদে গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পাশাপাশি মা ছেলেকে দাফন করা হয় বলে আরজুর মামাত ভাই তানজিদ হোসেন খান জনকণ্ঠকে জানান। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল মামুন জনকণ্ঠকে জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে নিহত আরজুর চাচা ইউনুস হাওলাদার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আরজুর স্বামী আমানুল্লাহকে একমাত্র আসামি করা হয়। পরকীয়ার সূত্র ধরেই মা ছেলে আমানুল্লাহ শ্বাসরোধে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গত বুধবার ঘটনার দিনই আমানুল্লাহকে আটক করে পুলিশ। গতকাল আমানুল্লাহকে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। পরকীয়া প্রেমিকা সুবর্ণাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন খান জনকণ্ঠকে জানান।
×