ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিদিন ওজন মাপা হচ্ছে ভেঙ্গে পড়েছে, বিমর্ষ দেখাচ্ছে ফাঁসির পর নাশকতা ঠেকাতে বারো জেলায় রেড এলার্ট

কামারুজ্জামানের ফাঁসি ॥ সব মহড়া শেষ

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৯ নভেম্বর ২০১৪

কামারুজ্জামানের ফাঁসি ॥ সব মহড়া শেষ

শংকর কুমার দে ॥ কুখ্যাত আলবদর, যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের আইনের বিধান নিয়ে চলছে বিতর্ক। এই বিতর্কের ভেতরও সম্পন্ন হয়েছে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম। কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য জল্লাদ, ফাঁসির মঞ্চ, ফাঁসির রশি (ম্যানিলা রোপ), মহড়া অনুষ্ঠানের সব কাজই শেষ করেছে কারাকর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন ওজন মাপা হচ্ছে কামারুজ্জামানের। ফাঁসি কার্যকর করার প্রক্রিয়ায় অপরাধীর ওজন খুবই জরুরী বিষয়। ফাঁসির রায় কার্যকর করার আগে এ ওজন পরীক্ষা জরুরী। এর ফলে খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন কামারুজ্জামান। একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী রায় ঘোষণার পর অপরাধী সাতদিন সময় পাবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার। আজ শেষ হবে সাত দিনের সময়সীমা। এর পরে যে কোন সময় সরকার এ ফাঁসি কার্যকর করতে পারে। অন্যদিকে আইনমন্ত্রীর সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী সকল আইনী প্রক্রিয়া শেষে ফাঁসি কার্যকর হবে। এ্যাটর্নি জেনারেলও জানিয়ে দিয়েছেন, রায় ঘোষণার পর ফাঁসির রায় কার্যকর করায় কোন বাধা নেই। জেল কর্তৃপক্ষের এ প্রস্তুতির পাশাপাশি সারাদেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। জামায়াতÑশিবির অধ্যুষিত জেলাগুলোতে জারি করা হয়েছে রেড এলার্ট। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জমানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলে জামায়াতÑশিবির সারাদেশে ব্যাপক নাশকতা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাতদিন আজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে আলোচিত হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেমড সেলে আটক কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য জল্লাদ, ফাঁসির মঞ্চ, ফাঁসির রশি (ম্যানিলা রোপ), মহড়া অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে কারাগার কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন তার শরীরের ওজন মাপা হচ্ছে। ফাঁসির রায় কার্যকর হতে যাওয়ার খবরে খুবই বিমর্ষ, বিষন্ন হয়ে ভেঙ্গে পড়েছেন কামারুজ্জামান। কারারক্ষীদের তাকে সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে রাখাসহ কারাগারের নিরাপত্তা ব্যাবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে তার প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার আবেদনও প্রস্তুত করে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন কারাকর্তৃপক্ষ। আজ কামারুজ্জামানের রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাত দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়া গেলে নির্বাহী আদেশে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। তবে কখন-কিভাবে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে সেই দিনক্ষণটি কঠোর গোপনীয়তায় মধ্যে রাখা হচ্ছে। সূত্র বলছে, যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলে জামায়াতÑশিবির নাশকতা ও নৈরাজ্য চালাতে পারে। এমন আশঙ্কায় সারাদেশসহ জামায়াতÑশিবির অধ্যুষিত দেশের ১২ জেলায় জারি করা হয়েছে হাই রেড এলার্ট। জেলাগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েনের প্রস্তুতি চলছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বসানো হয়েছে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা। প্রস্তুত থাকছে র‌্যাবের হেলিকপ্টার। যে কোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে আগাম কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। যারা নাশকতা চালানোর চেষ্টা করবে তাদের শক্তহাতে প্রতিহত করা হবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বুধবার জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর পরই জামায়াতে ইসলামী গত বৃহস্পতি, রবিব ও সোমবার তিন দিন হরতালের ডাক দেয়। হরতালের ডাক দিয়ে মাঠে নামেনি জামায়াতÑশিবির। রবিবারের হরতালের মধ্যেই আরেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায় হয়। তার রায়ের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে জামায়াত-শিবির। আর সোমবারের হরতালের মধ্যেই কুখ্যাত নরঘাতক জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় ঘোষণা করে আদালত। এ রায়ের প্রতিবাদে গত বুধবার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে জামায়াত-শিবির। শুধু পবিত্র আশুরার জন্য গত মঙ্গলবার কোন হরতাল ছিল না। এবার জামায়াত-শিবির ৫ দিন হরতাল পালন করলেও হরতালে সাড়া মেলেনি। দেশের দুই-একটি জেলা ব্যতীত কোথাও জামায়াত-শিবিরের তেমন কোন তৎপরতাও দেখা যায়নি। কামরুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের পর জামায়াত-শিবির ভিন্ন কৌশলে মাঠে নেমে বড় ধরনের হামলা চালাতেই হরতালে মাঠে নামেনি বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যোগ দিতে পারে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা। তাদের হামলার টার্গেটে এবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী রয়েছে হামলার টার্গেটে। জামায়াত-শিবির এবার ঢালাও হামলা নাও চালাতে পারে। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর পক্ষে; যাতে হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। ঢাকাতেও জামায়াত-শিবির ব্যাপক নাশকতার পরিকল্পনা করছে। ঢাকার চারদিকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ঢাকায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা মোতাবেক জামায়াত শিবির রাজাকারদের প্রধান দলনেতা গোলাম আযমের মৃত্যুর পর সারাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে ঢাকায় আনে। গোলাম আযমের জানাজায় এসব লোকজনকে দিয়ে জামায়াত-শিবির বড় ধরনের শোডাউন দেয়ার চেষ্টা করে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা জামায়াতÑশিবিরের কর্মী-ক্যাডারের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশেই নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট বিচারক ও প্রসিকিউটররা, সাক্ষী, আইনজীবী, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান চলছে। দেশের সব বিভাগীয় শহরে থাকছে বিশেষ নিরাপত্তা। বিভাগীয় শহরের প্রবেশপথে একাধিক চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠে থাকছে অতিরিক্ত পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াত, গোয়েন্দা পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, মহিলা পুলিশ ও সাদা পোশাকের গোয়েন্দা। তাদের সঙ্গে থাকছে জলকামান, এপিসি (আর্মার পার্সোনাল কেরিয়ার), পিপার স্প্রে, টিয়ারগ্যাসসহ প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ নিরাপত্তা থাকছে দেশের অন্তত ১২টি জেলায়। যেসব জেলায় হাই রেড এলার্ট জারি করা হয়েছেÑসাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, নাটোর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার ও পাবনা। এ ছাড়া বগুড়া জেলাকে স্পর্শকাতর বিবেচনায় নিয়ে রেড এলার্ট জারিসহ বিশেষভাবে সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। জামায়াত-শিবিরের প্রভাব থাকায় এসব জেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে যশোরের অভয়নগর, মরিরামপুর, ঋষিপাড়া ও অভয়নগরের মালোপাড়া, সাতক্ষীরা সদর, রাজশাহীর বাঘা, দিনাজপুর সদর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, রংপুরের পীরগঞ্জ, কাউনিয়া, গাইবান্ধার পলাশবাড়ি, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও সদরের পারেয়া ও নীমবাড়ি, পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া এবং কক্সবাজারের রামু এলাকায় হাই এলার্ট জারি করা হয়েছে। এসব এলাকায় যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে আগাম নির্দেশ জারি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির কুখ্যাত রাজাকার মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদ ওরফে দেইল্যা রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর এসব জায়গায় জামায়াত-শিবির নারকীয় তা-ব চালিয়েছিল। দোকানপাট, বাড়িঘর, উপাসনালয় তছনছ করে দিয়েছিল। জামায়াত-শিবিরের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত অর্ধশত সদস্য। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। এবারও কুখ্যাত নরঘাতক কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হলে এসব এলাকায় তা-ব চালাতে পারে জামায়াতÑশিবির। সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে যেমন তা-ব চালানো হয়েছিল এবারও সে রকম অপচেষ্টা চালাতে পারে জামায়াত-শিবির। পুলিশ মহাপরির্দশ হাসান মাহমুদ খন্দকার সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কড়া নির্দেশনা জারি করেছেন। পাশাপাশি যেকোন ধরনের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজন অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে আগাম নির্দেশ দিয়েছেন।
×