ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কর সংগ্রহের কৌশল বদলাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১১ নভেম্বর ২০১৪

কর সংগ্রহের কৌশল বদলাচ্ছে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ এক সময় কর কাকে বলে এটিই জানত না গ্রামের মানুষ। নিজের জায়গা, নিজের বাড়ি, নিজের সম্পদ তার জন্য আবার ইউনিয়ন পরিষদে কিসের টাকা দিতে হবে? এমন ধারণাই ছিল সাধারণ মানুষের। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর যাঁরা কর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন তাঁদেরও কোন মাথাব্যথা ছিল না। বিশেষ করে জনগণের ভোটে যাঁরা নির্বাচিত ছিলেন সেসব জনপ্রতিনিধি ঘোষণাই দিতেন নির্বাচিত হলে তাঁরা কোন কর নেবেন না। কিন্তু আজ এসব কিছুই অতীত হয়ে গেছে। পরিস্থিতি বদলে গেছে। বদলে গেছে জনপ্রতিনিধিদের সেই পুরনো ভয়ের ভ্রান্ত ধারণা। পাশাপাশি সাধারণ মাুনষও হয়েছেন সচেতন। গ্রামে অনেক কিছুই বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে কর সংগ্রহের সংস্কৃতিও। গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কর মেলা। মানুষ আনন্দের সঙ্গে সেগুলোতে এসে হোল্ডিং ট্যাক্সসহ বিভিন্ন করের টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনই দিন বদলের চিত্র দেখা গেছে সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এ উদ্যোগটি ভাল। কেননা ইউনিয়নবাসী যদি সামান্য ১০ টাকা (উদাহরণস্বরূপ) হোল্ডিং ট্যাক্স না দেয়, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদে তাদের অংশগ্রহণ থাকে না। অন্যদিকে যারা ট্যাক্স দেয় তারা খোঁজখবরও রাখে। এতে ইউপির স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। তবে ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্সের সোর্স বাড়াতে হবে। বেশিরভাগ সোর্স কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে নিলে হবে না। স্থানীয় সরকারের আয় বাড়লে ইউনিয়ন পরিষদগুলো শক্তিশালী হবে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সিরাজগঞ্জে ইউনিয়নে মেলা করে কর আদায়ের যিনি পথপ্রদর্শক তিনি হচ্ছেন ৯ নং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নং ওয়ার্ডের সদস্য সবুর আলী শেখ। শুরুর গল্পটা জনকণ্ঠকে জানান তিনি। সবুল আলী বলেন, ১২ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করছি। কিন্তু এতদিন এ বিষয়টাতে গুরুত্ব দেইনি। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের কথা। আমাদের গ্রামের মসজিদে পায়খানা ছিল না। সরকারীভাবে অনেক চেষ্টা-তদবির করলাম। না, কোন লাভ করতে পারলাম না। তখন ভাবতে থাকলাম কিভাবে কি করা যায়। এদিকে মুসল্লীরা আমার কাছে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন। এমন সময় মাথায় বুদ্ধি এলো। একদিন জুম্মার নামাজের সময় মসজিদে ঘোষণা দিলাম আপনারা ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্স দেন না। এটি ঠিক না। এবার সবাই ট্যাক্স দেবেন, হাতে হাতে না দিয়ে ব্যাংকে জমা দেবেন। আপনাদের টাকার দায়িত্ব আমার। আপনারাই কাজ করবেন, আপনারাই বিল জমা দেবেন আর সেই বিল পরিশোধ করবে ইউনিয়ন পরিষদ। সবাই সম্মত হলেন। তারপর এক জায়গায় দিনক্ষণ ঠিক করে করের টাকা সংগ্রহ করা হলো। ৩৫ হাজার টাকা উঠানো হলো। সেই টাকায় তৈরি করা হয় মসজিদের পায়খানা। এরকম উদ্যোগে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া আমাকে উজ্জীবিত করে। তারপর থেকে প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামে গ্রামে মেলার আয়োজন করে কর আদায় করা হচ্ছে। এতে উৎসাহিত হয়েছেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান। তিনি এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই কর মেলা করছেন। এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব এস এম মনিরুল ইসলাম জানান, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে প্রতিবছরই নিয়মিত সকল ওয়ার্ডে মে থেকে জুন মাসের মধ্যে কর মেলা করা হচ্ছে। মাইকিং করে ব্যাপক প্রচার করা হয়। এতে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। আমাদের ইউনিয়নের এ উদাহরণ এখন পুরো সিরাজগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ১০ নং সায়দাবাদ ইউনিয়ন, ৪ নং শিয়ালকোল ইউনিয়ন এবং ৬ নং ছনগাছা ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে নিয়মিত কর মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। ৯ নং কালিয়াহরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের কর সংগ্রহের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩ লাখ টাকা কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৩৭৫ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা কর আদায়ের বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৪৩৬ টাকা। এছাড়া চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এর কাছাকাছি আদায় হবে। ইউনিয়নের সাধারণ বাসিন্দা দীঘলকান্দি গ্রামের কৃষক আব্দুল গনি জানান, আগে আমাদের কাছে কেউ কর নিত না। এখন আমরা কর দেই। এই টাকা দিয়ে আমাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। শুধু আমিই নই, আমাদের গ্রামের অনেক মানুষই এখন কর দেয়। প্রায় একইরকম মন্তব্য করেন ওই ইউনিয়নের জুরান আলী, সোনেকা বেগমসহ আরও অনেকে। কর বিষয়ে ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য হালিমা বেগম জানান, হোল্ডিং ট্যাক্স নিলে মানুষ ভোট দেবে না এই ভয়ে আগে কর নেয়া হতো না। কিন্তু দেখা গেল গত পরিষদে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের ১২ জনের মধ্যে কর না তুলেই চলতি পরিষদ নির্বাচনে ফেল করেছেন ৯ জন। আর যাঁরা কর আদায় করতেন তাঁদের মধ্যে ৩ জন পাস করেছেন। তাছাড়া আগে সাধারণ মানুষও বলত ভোট দিয়েছি, আবার ট্যাক্স কিসের। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। তারাও বুঝতে শিখেছে। সবাই কর দিতে চায়। কর মেলা পুরো জেলার সবগুলো ইউনিয়নে ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এটির ফল ভাল হলে পুরো জেলায় ছড়িয়ে দিতে কোন সমস্যা নেই। এ বিষয়ে ভেবে দেখা হচ্ছে। ৯ নং কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান এ বিষয়ে জানান, ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের প্রধান উৎস হোল্ডিং ট্যাক্স, হাটবাজার, জলমহাল, খেয়াঘাট ইজারার অর্থ ও ভূমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ। কিন্তু বিগত কয়েক বছর পূর্বে হাটবাজার ও জলমহাল ইজারা উপজেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। ভূমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ বাবদ প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণও কমে গেছে। তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্মানি ভাতা ও সর্বপ্রকার প্রশাসনিক খরচ মাত্র জনগণের ট্যাক্সের টাকার ওপর নির্ভরশীল। তাই কর আদায়ে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে।
×