ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতা ব্যানার্জী ‘হাসিনা দিদির’ প্রতি বিমুখ হলেন কেন?

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১২ নভেম্বর ২০১৪

মমতা ব্যানার্জী ‘হাসিনা দিদির’ প্রতি বিমুখ হলেন কেন?

পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জী রাজ্যের গত নির্বাচনে যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ গ্রহণ করেন তখন সকলের আগে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসিনা-রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি দেশের স্বার্থে সকলের সাথে মৈত্রী ও সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে চান। পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসু বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই বর্ষীয়ান ভারতীয় নেতা শেখ হাসিনাকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি বণ্টন সমস্যা, এমনকি ফারাক্কা বাঁধ চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের শাসন শেষে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর দুই বাংলারই জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ ও স্বার্থে মমতা ব্যানার্জীকে রাজ্যটির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হাসিনা অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং মৈত্রী ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মমতাও তাঁর অভিনন্দনের জবাবে শেখ হাসিনাকে ‘বড় দিদি’ (বষফবৎ ংরংঃবৎ) ডেকে বাংলাদেশের মৈত্রী ও সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে রবীন্দ্রনাথের দেড় শতকের জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে বাংলাদেশে রবীন্দ্র জাদুঘর ট্রেনও পাঠাতে চেয়েছিলেন। তখন মনে হয়েছিল বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হওয়া সত্ত্বেও দুই বাংলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক ও সৌহার্দ্যমূলক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে। এই প্রত্যাশা ও সম্ভাবনাটিকে অত্যন্ত দ্রুত ধ্বংস করতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী এবং অত্যন্ত দ্রুত ভোল পাল্টেছেন। ক্ষমতায় পাকাপোক্তভাবে থাকার জন্য একজন রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী কত দ্রুত ইউটার্ন দিতে পারেন এবং ‘মাটি ও মানুষের নেত্রী’ থেকে রাতারাতি গণবিরোধী শাসকের ভূমিকায় রূপান্তরিত হতে পারেন, মমতা ব্যানার্জী তার একটি বড় প্রমাণ। ভারতের সাবেক কংগ্রেস দলীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে চুক্তি সম্পাদনে কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ ঢাকায় আসেন, তখন মমতা ব্যানার্জী আকস্মিকভাবে বেঁকে বসেন। শুধু চুক্তি সম্পাদনে বিরোধিতা নয়, তিনি ঢাকায় আসতেও অসম্মতি জানান। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘকালের কয়েকটি জটিল সমস্যার সমাধান, মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক আরও দৃঢ় হওয়ার যে সম্ভাবনা সূচিত হয়েছিল তা তখনকার মতো ব্যর্থ হয়। ভারতে মনমোহন সরকার দারুণভাবে বিব্রত হন। বাংলাদেশে হাসিনা সরকার দেশের মানুষের কাছে মুখ হারান। হাসিনাবিরোধী এবং ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক দলগুলো বাংলাদেশে সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রচারণার ঝড় তুলে হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। মনে হয়েছিল বাংলাদেশে এমনটা যে ঘটতে পারে তা মমতা ব্যানার্জী আন্দাজ করেছিলেন। তাই একদিকে দিল্লীর কংগ্রেস সরকারকে কোণঠাসা করা এবং অন্যদিকে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় সহযোগিতাদানের জন্য তিনি এই ভূমিকাটি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হয়ত আশা করেছিলেন দিল্লীতে নড়বড়ে কংগ্রেস সরকারের অবস্থান আরও নাড়িয়ে দিতে পারলে তিনিই হবেন দিল্লীর ভবিষ্যত সম্রাজ্ঞী (নরেন্দ্র মোদির বিরাট আবির্ভাব তখনও ঘটেনি) এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে পশ্চিমবঙ্গে যে বিরাট অবাঙালী মুসলিম ভোট ব্যাংকটি গড়ে উঠেছে তার সহায়তায় রাজ্যটিতে তার দলের রাজত্ব স্থায়ী হবে। উল্লেখযোগ্য যে, পশ্চিমবঙ্গে গত বহু বছর যাবত ভারতের বিহার ও অন্যান্য রাজ্য থেকে অবাঙালী মুসলমানদের এসে বসতি স্থাপনে এবং বাংলাদেশ থেকেও বহু বিহারী দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ায় সেখানে তাদের একটি শক্তিশালী সামাজিক অবস্থান গড়ে উঠেছে, তারা সেক্যুলার বাংলাদেশ এবং সেক্যুলার আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোর বিরোধী। পশ্চিমবঙ্গে এরা এখন ‘উর্দুভাষী বাঙালী’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমল থেকে জীবন-জীবিকার তাগিদে এরা এসে কলকাতা শহর ও তার আশপাশে ডেরা বেঁধেছে। রাজ্যের বাংলাভাষী বাঙালীদের চাইতে বর্তমানে এদের অবস্থা অনেক উন্নত। ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকরিবাকরি সর্বত্রই এদের দাপট বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে এই যে শক্তিশালী ভোটব্যাংক, এই ভোট ব্যাংককে খুশি রাখার স্বার্থেই তৃণমূলের আগে বামফ্রন্ট সরকারও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে সাম্প্রদায়িকতাকে তোষণ এবং নানা গণবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছিল। বামফ্রন্টের মন্ত্রিসভাতে বাঙালী পরিচয়ের উর্দুভাষীদের সংখ্যা শক্তিই ছিল বেশি। তাদের চাপেই বামফ্রন্ট সরকার তসলিমা নাসরিনকে রাজ্য থেকে বিতাড়ন করেছিল, এমনকি তার বই নিষিদ্ধ করার মতো চরম বিতর্কিত কাজেও হাত দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজের অধিকাংশের সমর্থন তাই বামফ্রন্ট সরকার হারায়। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষক দলন নীতি গ্রহণ করে বামফ্রন্ট সরকার জনসমর্থন হারিয়ে দিল্লীর জামে মসজিদের খতিবকে ডেকে এনেছিলেন মুসলিম ভোটব্যাংকের ভোট রক্ষার আশায়। মমতা ব্যানার্জী সাবেক বামফ্রন্ট সরকারের এই বড় বড় বিচ্যুতি ও গণবিরোধী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচনে বিশাল জয়ের অধিকারী হন। এমনকি লোকসভা নির্বাচনেও সাফল্য দেখান। সম্ভবত এই বিরাট নির্বাচন-সাফল্যই তাঁর মাথা গরম করে দেয় এবং তিনি দিল্লীশ্বরী হওয়ারও স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ভারতের একশ্রেণীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতার বিরাট উত্থান মার্কিন প্রশাসনের কংগ্রেসবিরোধী অংশকে আশান্বিত করে তুলেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে হিলারি ক্লিনটনের অকস্মাৎ পশ্চিমবঙ্গে উড়ে আসা এবং ভারতের একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করা ছিল একটি অকল্পনীয় ও অভাবিত ব্যাপার। এই ব্যাপারটি কেন ঘটেছিল সে সম্পর্কে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, মার্কিন প্রশাসন তৃণমূল নেত্রীকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁকে দিল্লীতে কংগ্রেসের বিকল্প সরকার গঠনের জন্য দাঁড় করানো যায় কিনা! পরে মোদিঝড়ে মমতার স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি কখনও একক শক্তিতে কখনও আন্না হাজারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মাথা তুলতে চেয়েছিলেন। বিজেপিকে হটিয়ে কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিকল্প শক্তি হতে চেয়েছেন। নরেন্দ্র মোদিকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পাঠানোরও হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের ভাঙ্গা দুর্গে আর সাফল্যের পতাকা ওড়েনি। মমতার এই স্বপ্ন ভঙ্গের জন্য তাঁর বহুরূপী নীতিই দায়ী। তিনি তাঁর দেশের মানুষের কাছে এখন চরিত্র ও নীতিহীন এবং বহুরূপী একজন নেত্রী হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি কখনও অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেস এবং কখনও সাম্প্রদায়িক বিজেপির সঙ্গে আঁতাত করেছেন, দুই দলের সরকারেই মন্ত্রিত্ব করেছেন। রাজ্যের গত নির্বাচনেও তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে জয়ী হয়েছেন এবং সরকার গঠন করেছেন। সেই জোট বেশিদিন টেকেনি। তিনি ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রস ও বিজেপির বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। পারেননি বরং পশ্চিমবঙ্গে ক্রমাগত বাংলাদেশবিরোধী নীতি অনুসরণ, সাম্প্রদায়িকতার নীতিকে ক্ষমতায় থাকার লোভে তোষণ এবং বাংলাদেশ থেকে পলাতক মৌলবাদী জঙ্গীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দান প্রভৃতি নীতি তাঁর এবং সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামফ্রন্ট এখনও শক্তিশালী অবস্থানে ফিরে আসতে না পারলেও মমতা সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করছে বিজেপি। মমতার এখন চারদিকে শত্রুবেষ্টিত অভিমন্যুর অবস্থায়। একদিকে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস, অন্যদিকে বিজেপি, তার পালিত মাওবাদী সন্ত্রাসীদের অংশটিও এখন তার বিরুদ্ধে। তিনি এখন আত্মরক্ষার্থে বিজেপির সঙ্গেও আপোস করতে প্রস্তুত বলে জানা গেছে। এই খবরটি দিয়েছে কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান। এই পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে, তৃণমূলের পক্ষ থেকে এখন বিজেপিকে বাজিয়ে দেখা হচ্ছে, দুই দলের মধ্যে কোন গোপন সমঝোতা করা যায় কিনা? দু’দিন আগে যে মমতা নরেন্দ্র মোদিকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পাঠাতে চেয়েছিলেন, স্টেটসম্যানের খবর সঠিক হলে এখন সেই মোদির দলের কাছে তিনি কৃপাপ্রার্থী। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস! মমতা ব্যানার্জীর হীনস্বার্থের রাজনীতির মুখোশ খুলে দিয়েছে বাংলাদেশের জঙ্গী গোষ্ঠী এবং তাদের প্রধান দল জামায়াতের সঙ্গে তার দলের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণের পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা তদন্তেই উঠে আসছে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদকে আর্থিক সহায়তা দানে তৃণমূল সম্পর্কিত ব্যক্তিদের, এমনকি একজন মুসলিম বিধায়কের সম্পর্কের তথ্যভিত্তিক অভিযোগ। এই ব্যাপারটিও এখন স্পষ্ট যে, রাজ্য সরকারের উদাসীনতা অথবা প্রশ্রয়দানের ফলেই বাংলাদেশ থেকে পলাতক মৌলবাদী জঙ্গীরা পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী ঘাঁটি গাড়তে পেরেছে, এমনকি শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রও সেখানে বসে পাকাতে পেরেছে। এই ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হয়েছে একটি আকস্মিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়, মমতা সরকারের পুলিশ বা গোয়েন্দাদের সাফল্যের জন্য নয়। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মমতা ব্যানার্জী দাঁত ফোটাতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও তিনি কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ক্ষমতার স্বার্থে অন্ধ হয়ে তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। নিজের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে সহায়তা দিয়েছেন। এসব ষড়যন্ত্রের একটিও সফল হয়নি; বরং তার জন্যই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। আমাকে পশ্চিমবঙ্গের এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, ‘আপনাদের খালেদা এবং আমাদের মমতার মধ্যে পার্থক্যটা কী, তা এখন আর বুঝতে পারছি না।’ লন্ডন মঙ্গলবার, ১১ নবেম্বর, ২০১৪
×