ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন সাহসী যুবকের কথা

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

তিন সাহসী যুবকের কথা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গত ৬ নবেম্বর বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা সোয়া ৭টা। আমরা তিন বন্ধু। প্রতিদিনের মতো বসে আছি রাজধানীর শ্যামলী সিনেমা হলের সামনের একটি চায়ের দোকানে। চা চলছিল, সেই সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা। ওইদিন যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করছিল জামায়াত-শিবির। হরতালের কারণে স্বাভাবিকভাবেই রাস্তায় যানবাহন কম ছিল। তবে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাচ্ছিল। কর্মচঞ্চল হচ্ছিল আশপাশের এলাকা। আচমকা অন্তত ১৫ জামায়াত-শিবিরকর্মী শ্যামলী সিনেমা হলের সামনের গলি থেকে ঝটিকা মিছিল করে। মিছিলকারীরা রাস্তায় উঠেই ৫টি বাস ভাংচুর করে। একটি লেগুনাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুরো এলাকার চিত্র মুর্হূতেই অনেকটা রণক্ষেত্রের মতো হয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচিতে পুরো এলাকায় এক অস্থির পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হুড়মুড় করে চোখের পলকে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে একের পর এক দোকানপাট। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। সবই হচ্ছে চোখের পলকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই। দেখে আর সহ্য হচ্ছিল না। এরপরই নেমে পড়ি সন্ত্রাসীদের ধরতে। তার পরের কাহিনী সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। খোদ রাজধানীতেই সিনেমার কাহিনীর মতো সেই কাহিনীরই বর্ণনা দিলেন সাহসী সেই তিন যুবক মুহম্মদ শহিদুল আলম খান কাজল, মোঃ মনির হোসেন জয় আর মোঃ হাসান মিয়া। আমরা সবাই প্রায় সমবয়সী। আড্ডার ফাঁকে দেখতে পেলাম চোখের পলকে মিছিলকারীরা যাত্রীবাহী বাস ভাংচুর করার পর একটি লেগুনাতে আগুন ধরিয়ে দিল। পুরো এলাকা এক প্রকার রণক্ষেত্রে পরিণত করে ফেলল তারা। মিছিলকারীরা যানবাহন ভাংচুরের পাশাপাশি দোকানপাটেও হামলা চালাতে থাকে। আতঙ্কে মানুষজন দৌড়াচ্ছিল। অনেক মা তাদের ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে প্রাণভয়ে অনেক কষ্টে দৌড়াচ্ছিলেন। যানবাহনের যাত্রীরা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছিলেন। এক প্রকার দরজা-জানালা ভেঙ্গে বের হচ্ছিলেন তাঁরা। দেখে আর সহ্য হচ্ছিল না। কাজল বলছেন, আমার মাথায় তখন রীতিমতো খুন চেপে যায়। মনির আর হাসানকে বললাম চল সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করি। যা করে আল্লাহ। বলে নিজেই লেগুনা গাড়িতে আগুন দেয়া এক সন্ত্রাসীর পিছু নেই। ওই সন্ত্রাসী আমাকে পিছু নিতে দেখে চোখের পলকে শ্যামলীর ৪ নম্বর গলিতে ঢুকে পড়ে। আমিও তার পিছুৃ পিছু দৌড়াতে থাকি। সে আমাকে লক্ষ্য করে একটি বোমা মারে। বোমা আমার শরীরে লাগাতে পারেনি। এতে রাগ আরও চড়ে যায়। পেছন থেকে ওই সন্ত্রাসীর ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। সন্ত্রাসী পড়ে গেলে তাকে জাপটে ধরি। সন্ত্রাসী আমাকে মারধর করতে থাকে। আমি তাকে ধরেই রাখি। আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। এরপর জনতা ওই সন্ত্রাসীকে গণধোলাই দেয়। তাৎক্ষণিক পুলিশ ওই সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে। কথায় কথায় অপর দুই সাহসী যুবক মনির আর হাসান বললেন, কাজল ভাই আমাদের সন্ত্রাসীদের পিছু নেয়ার কথা বলে নিজেই সন্ত্রাসীর পিছু নেয়। আমরা গেলাম কি গেলাম না, তাও তিনি পেছন ফিরে দেখেননি। আমরা দেখছিলাম লেগুনায় আগুন দেয়া এক সন্ত্রাসী দৌড়াতে দৌড়াতে পালাচ্ছে। ওই সন্ত্রাসী অন্তত ৫০ গজ সামনে চলে গেছে দৌড়াতে দৌড়াতে। আমরা দৌড়ে গিয়ে তা হয়ত ধরতে পারব না। তাই বুদ্ধি করে আমরা মোটরসাইকেল নিয়ে ওই সন্ত্রাসীর পিছু ধাওয়া করি। সন্ত্রাসী আমাদের পিছু নেয়া দেখে ততক্ষণে শ্যামলীর ২ নম্বর গলিতে ঢুকে পড়ে। আমরাও তার পিছু পিছু ২ নম্বর গলিতে ঢুকে পড়ি। যা থাকে কপালে, ওই সন্ত্রাসীকে আজ ধরবই। এমন মনোভাব থেকেই ওই সন্ত্রাসীর পিছু নেই। ওই সন্ত্রাসী খুব চালাক। সে রাস্তায় এলোমেলো অর্থাৎ আঁকাবাঁকা দৌড়াচ্ছিল। এতে আমরা বার বার মোটরসাইকেল তার পিছু পিছু আঁকাবাঁকা করতে পারছিলাম না। আমরা তার পিছু না ছাড়ায় সে আমাদের লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালাতে থাকে। এভাবে অন্তত আধ কিলোমিটার এলাকা তার পিছু নেই। আধ কিলোমিটারের মধ্যে ওই সন্ত্রাসী আমাদের লক্ষ্য করে ৬টি বোমা হামলা করে। শেষ পর্যন্ত যখন আর পেরে উঠছিলাম। তখন নিরুপায় হয়ে সন্ত্রাসীকে ধরতে আমরা সজোরে মোটরসাইকেল ওই সন্ত্রাসী বরাবর চালিয়ে দেয়। মোটরসাইকেলের সজোরে ধাক্কা খেয়ে ওই সন্ত্রাসী রাস্তার পাশে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও মোটরসাইকেলসহ ওই সন্ত্রাসীর ওপর পড়ে যাই। এরপর সন্ত্রাসীকে জাপটে ধরি। এ সময় জনতা ওই সন্ত্রাসীকে গণধোলাই দেয়। পরে পুলিশ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে। আমাদের মাথায়ই ছিল না যে, সন্ত্রাসীসহ আমরা দুইজন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারতাম। আমাদের শরীরের অনেক জায়গায় জখম হয়েছে। শরীর কেটে রক্ত বের হচ্ছিল। সে দিকে আমাদের কোন খেয়ালই ছিল না। আমরা যে সন্ত্রাসীকে ধরতে পেরেছি সেই আনন্দে রীতিমতো আত্মহারা ছিলাম। আমাদের মোটরসাইকেলটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাতেও কোন আফসোস নেই। আমরা যে একটি ভাল কাজ করতে পেরেছি তাই ভেবে খুবই ভাল লাগছে। ভবিষ্যতেও আমাদের সামনে সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হলে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করব। সন্ত্রাসীরা অন্তত ১৫ জন ছিল আর আমরা মাত্র তিনজন ছিলাম। আসলে সমাজে সন্ত্রাসীর সংখ্যা কম। ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি। আমরা যদি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হই সমাজ থেকে সন্ত্রাস নিমর্ূূল হতে বাধ্য। যদিও এ ধরনের কাজে নিরাপত্তার বিষয় আছে। হয়ত সন্ত্রাসীরা আমাদের খুঁজছে। তাতে কী! সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ হই, সন্ত্রাসীদের দেখে আমাদের ভয় পেতে হবে না, বরং সন্ত্রাসীরাই আমাদের দেখে ভয় পাবে। দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল হতে বাধ্য। সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে কোন ছাড় নাই। দেশ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে। এতে দেশের শান্তি হবে। দেশ শান্তিতে থাকলে মানুষ আপনাআপনিই শান্তি পাবে। তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃত ওই দুই সন্ত্রাসী কাউসার আর রেজা জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার। তাদের কাজই জামায়াত-শিবিরের দলীয় নির্দেশে যানবাহনে ভাংচুর অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- চালানো। প্রসঙ্গত, এই তিন সাহসী যুবককে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ গত সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করেন। অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামসহ উর্ধতন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সাহসী তিন যুবকের হাতে তুলে দেন প্রশংসাপত্র আর নগদ টাকা। তাদের নিরাপত্তায় পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেন ডিএমপি কমিশনার।
×