ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত খান জাহান আলী (রহ.)

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১৪ নভেম্বর ২০১৪

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত খান জাহান আলী (রহ.)

গত ২৫ অক্টোবর ছিল হযরত খান জাহান আলী রহমাতুল্লাহি আলায়হির ৫৫৫তম ওফাত বার্ষিকী। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর বুধবার বাগেরহাটে নিজ হাবেলীতে প্রায় ১০০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তিনি ইন্তিকাল করেন হিজরী ৮৬৩ সনের ২৬ জিলহজ্জ অর্থাৎ ঈদুল আযহার ১৬ দিন পর। ঈদুল আযহার পরে আমার সস্ত্রীক ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আদত রয়েছে। এবার (২০১৪ খ্রি.) শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও নিজ গাড়িতে করে খুলনা যাই। খুলনায় আমার এবং আমার স্ত্রী মাহ্মুদা বেগম মায়ার অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে। আমার এক শ্যালক জাহিদ হাসান খুলনার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ম্যানেজার। ওর বৌ শিল্পী কিছুদিন ধরে আমার স্ত্রীকে খুলনা যাবার জন্য বলে আসছিল। তাই আমরা খুলনা যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। মাওয়া পাড়ি দিয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে মধুমতি সেতু অতিক্রম করে সুন্দর সড়ক ধরে খুলনার রূপসা নদীর ওপর খান জাহান আলী সেতু পার হয়ে খুলনা গেলাম। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাগেরহাটে খান জাহান আলীর মাযার শরীফ যিয়ারত করা। এই জিলহজ্জ মাসেই তো তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাযার গাত্রে কয়েকটি আরবী ফারসীতে উৎকীর্ণ শিলালিপি রয়েছে। মাযার শরীফের সামনেই রয়েছে বিশাল দীঘি। এই দীঘিতে রয়েছে কুমির। এই কুমির নিয়ে নানা ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে। খান জাহান আলীর প্রকৃত নাম উলুঘ খান। নাম দৃষ্টে অনুমিত হয় তিনি তুর্কী বংশীয় ছিলেন। খান জাহান তাঁর উপাধি। বৃহত্তর যশোর-খুলনা অঞ্চলে তিনি পীর খাঞ্জালী নামে সমধিক পরিচিত। ধারণা করা হয়, ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লঙ ভারত অভিযানে এসে দিল্লী উপনীত হন। তাঁর আক্রমণের মোকাবেলা করতে যেয়ে দিল্লীর সম্রাট মাহমুদ তুগলক পরাজিত হয়ে গুজরাটে পলায়ন করেন। তৈমুর লঙের বিশাল সৈন্যবাহিনী দিল্লী এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে, অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবং দিল্লী নগরী বিরান নগরীতে পরিণত হয়। এই সময় খান জাহান আলী জৌনপুর থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ এবং প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। তাঁর এই বাহিনীতে কয়েকজন সূফী ও প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানীর দিকে না যেয়ে অজ্ঞাত কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে আসেন। তিনি প্রথম বর্তমান যশোর শহর থেকে ১১ মাইল উত্তরে অবস্থিত বারোবাজারে এসে ছাউনি ফেলেন। প্রাচীনকালে এই বারোবাজার গঙ্গারিডীর রাজধানী ছিল। খানজাহান আলীর আগমনে এই প্রাচীন নগরী নতুন প্রাণ লাভ করে। এখানে একটি দীঘি খনন করা হয় এবং নির্মিত হয় একটি মসজিদ। এখানে তিনি বেশিদিন থাকেননি। কিন্তু তাঁর স্মৃতি থেকে যায়। মসজিদটি খাঞ্জালী মসজিদ হিসেবে অভিহিত থাকে। এক পর্যায়ে মসজিদটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান আবু বকর সিদ্দীকী (রহ.) এই মসজিদটিকে জীবন্ত করেন। তাঁর নির্দেশে এটিকে সংস্কার করা হয় এবং এখানে নিয়মিত সালাত আদায় করা হয়। বারোবাজার থেকে খান জাহান আলী মুরলীতে এসে অবস্থান করেন। তাঁর বিশাল বাহিনীর আগমনে এখানে একটা কসবা বা শহর গড়ে ওঠে। এখানে তিনি তাঁর দু’জন খাস মুরীদকে ইসলাম প্রচার ও শাসনকার্য পরিচালনার জন্য রেখে যান। যাঁদের একজনের নাম শাহ্ গরীব এবং অন্যজনের নাম শাহ বুরহান। এঁদের মাযার এখনও যশোরে রয়েছে। মুরলী কসবাই আজকের যশোর শহর। এখান থেকে তিনি পায়গ্রাম আসেন যার বর্তমান নাম পায়গ্রাম কসবা। ইতোমধ্যে বহু লোক তাঁর সংস্পর্শে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর সংস্পর্শে এসে গোবিন্দ ঠাকুর নামে এক অভিজাত ব্রাহ্মণ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর মুসলিম নাম হয় মুহম্মদ তাহির আলী। এই তাহির আলী থেকে পীরালী ব্রাহ্মণ ও পীরালী মুসলমান। জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পীরালী ব্রাহ্মণের কুমারী বংশেই জন্মগ্রহণ করেন। আর মওলানা আকরম খাঁ পীরালী মুসলিমের খান বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নড়াইলের পেরইল গ্রাম পীর আলী তাহিরের স্মৃতিধারণ করে আছে। এই তাহির আলী পরবর্তীতে খান জাহান আলীর প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। খান জাহান আলী তাঁর সঙ্গে যে সকল সূফী ছিলেন তাঁদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে বৃহত্তর যশোর-খুলনা অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। সেই সব সূফীগণ ছিলেন শাসনকার্যে পারদর্শী। তাঁদের বংশধরদের অনেকেই এই অঞ্চলে রয়েছেন। সাতক্ষীরার দেবহাটা থানার মায়াহাটীতে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবার। অনেক পথ সফর শেষে খান জাহান আলী সদলবলে বাগেরহাটে এসে স্থায়ী বসত স্থাপন করেন। এবং খলীফাতবাদ রাজ্যের পত্তন করেন। নির্মাণ করেন ষাট গম্বুজ, নয় গম্বুজ মসজিদ। ষাট গম্বুজ মসজিদের গম্বুজ সংখ্যা আসলে ৭৭টি। এটা যেমন ছিল সালাতের স্থান, তেমনি ছিল সেনানিবাস। তিনি এই বৃহৎ অঞ্চলে একটি কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন। নোনা পানির এই অঞ্চলে মিঠা পানির ব্যবস্থা করেন অসংখ্য বিশাল বিশাল দীঘি খনন করে, যার অনেকই খাঞ্জালীর দীঘি নামে পরিচিত। অনেক সুরম্য রাস্তা নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত রাস্তা খাঞ্জালীর জাঙ্গাল নামে অভিহিত হয়। তিনি এই অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা স্থাপন করেন। এই অঞ্চলে তিনি পাথরের তৈরি মসজিদ নির্মাণ করেন। দূর-দূরান্ত থেকে পাথর নিয়ে আসাকে কেন্দ্র করে অনেক কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এখনও শোনা যায়। তিনি ছিলেন একজন সূফী, সিপাহ্সালার, ইসলাম প্রচারক, স্থপতি। খান জাহান আলী ইন্তিকাল করেন ২৫ অক্টোবর বুধবার আর তাঁকে দাফন করা হয় তাঁরই নির্মিত মাকবারায় ২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। তাঁর মাযার শরীফের একটি শিলালিপিততে বলা হয়েছে : আল্লাহর নগণ্য বান্দা রব্বুল আলামীনের রহমত প্রত্যাশী সাইয়েদুল মুরসালীনের অনুরক্ত খাঁটি আলেমগণের বন্ধু ইসলাম ও মুসলিমগণের প্রতিষ্ঠাকারী উলুগ খান-ই জাহানÑ তার প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহ্র রহমত ও সন্তুষ্টি। তিনি ৮৬৩ সনের ২৬ জিলহজ্জ বুধবার রাতে এই নশ্বর দুনিয়া থেকে চিরস্থায়ী আবাসভূমিতে প্রস্থান করেন এবং উক্ত মাসের ২৭ তারিখ বৃহস্পতিবার তাঁকে দাফন করা হয়। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
×