ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জেলা প্রশাসকসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

কক্সবাজারে বিদ্যুত কেন্দ্রের ২২ কোটি টাকা আত্মসাত

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ নভেম্বর ২০১৪

কক্সবাজারে বিদ্যুত কেন্দ্রের ২২ কোটি টাকা আত্মসাত

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ জেলার মহেশখালীতে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রের ২২ কোটি ২৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার বিকেলে এ মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে কক্সবাজারের মহেশখালী মাতারবাড়ীতে বাস্তবায়নাধীন দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নামে ২৩ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন ও সংঘবদ্ধ দালাল চক্র জড়িত বলে জানা গেছে। জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তদন্তে ভুয়া দলিল ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রকল্পের ২৩ কোটি টাকা হরিলুটের তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। আত্মসাতকৃত এ টাকা উদ্ধারের জন্য মহেশখালীর মাতারবাড়ী দ্বীপের ২১ জনের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করেছে জেলা প্রশাসন। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে জেলা প্রশাসনের চার কর্মচারী ভূমি হুকুমদখল শাখার সাবেক প্রধান সহকারী আবুল কাশেম মজুমদার, কানুনগো আবদুল কাদের, সার্ভেয়ার ফখরুল ইসলাম ও বাদশা মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। জেলা সার্টিফিকেট অফিসার মোঃ মোবারক হোসেন ২১টি সার্টিফিকেট মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। ঘটনা আরও তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহেশখালীর মাতারবাড়ী দ্বীপের কিছু প্রতারক প্রকল্পটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে এই বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, মৎস্য বিভাগের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। মাতারবাড়ীতে সরকার ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পটির জন্য এক হাজার ৪১৪ একর জমি হুকুমদখল করা হয়। এই বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। জাপানি সংস্থা জাইকা এ প্রকল্পে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থায়ন শুরু করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মাতারবাড়ী এলাকার রইচ উদ্দিনের মালিকানাধীন মেসার্স আলিফ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ক্ষতিপূরণের ছয় কোটি ৯৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মাত্র ৫০ শতক জমির ওপর স্থাপিত এই রুগ্ন শিল্পটির মূল্য ২০ লাখ টাকার বেশি হবে না। অথচ ভুয়া দলিল এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাত করে ক্ষতিপূরণে প্রায় ৭ কোটি টাকা অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করেছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, লবণ মিলটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারী জমিতে গড়ে তোলা হয়। ক্ষতিপূরণ দেয়ার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে আপত্তি দেয়া হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। অন্যদিকে রইচ উদ্দিনের ভাই জমির উদ্দিনও একই কায়দায় চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠের ভুয়া দলিল দিয়ে ২ কোটি চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এভাবে জাল দলিল ও ভুয়া সনদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাত করে অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক ও দালাল চক্র। প্রকল্পের ক্ষতিপূরণের টাকা মূল্যায়ন করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা জালিয়াতিতে নামে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া কাগজ সৃজনের মাধ্যমে মৎস্য কর্মকর্তাদের দিয়ে ‘অবাস্তব রিপোর্ট’ তৈরি করে হাতিয়ে নেয়া হয় বিপুল টাকা। মৎস্য কর্মকর্তার রিপোর্টে চিংড়ি ঘেরে প্রতি কেজি চিংড়ির মূল্য ৮শ’ টাকা হিসেবে মজুদ দেখানো হয় অস্বাভাবিক হারে। মহেশখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মসিউর রহমানের অবাস্তব প্রতিবেদনের ফলে ক্ষতিপূরণের বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জালিয়াত চক্র। রিপোর্টে মজুদ বেশি দেখানোর অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন মৎস্য কর্মকর্তা মসিউর রহমান। একইভাবে অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ইলিয়াস রহমানের বিরুদ্ধে। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে রয়েছে দালাল চক্রের গভীর সখ্য। ইলিয়াস রহমান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘বিদ্যুত প্রকল্পে ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণ করছে জেলা প্রশাসন। এখানে আমার কোন হাত নেই।’ কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন এ ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পটির যাত্রায় জালিয়াতির ঘটনা আঁচ করতে পেরেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ এনিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ জাফর আলম বলেছেন, ‘জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও মহেশখালীর ইউএনওকে নিয়ে ঘটনার সরেজমিন তদন্ত শুরু করেছি।’ যাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্চু ও প্রকল্পের বিরোধিতাকারী হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম প্রকাশ ভেণ্ডার রফিক। এছাড়া স্থানীয় নূর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সেলিম, নূরুল ইসলাম, আবুল বশর, রুহুল আমিন, সেলিম, জমির উদ্দিন, ছমি উদ্দিন, এরফান, আনিসুর রহমান, দানু মিয়া, হারুন, মীর কাসেম, রিদুয়ান, আমিনুল ইসলাম, ছকি আলম, জাহাঙ্গীর আলম ও আশরাফ আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদিকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের সবচেয়ে বেশি ৯ কোটি টাকা নিয়েছেন যে দুজন সেই রইচ উদ্দিন ও তার ভাই জমির উদ্দিনের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মামলা হয়নি। রইচ উদ্দিন বলেছেন, ক্ষতিপূরণের আরও অনেক টাকা তিনি এখনও পাওনা রয়েছেন।
×