ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সেচ কার্যক্রম অচল করার পাঁয়তারা

তিস্তা ব্যারাজ ঘেঁষে চলছে অবৈধ পাথর উত্তোলন

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২২ নভেম্বর ২০১৪

তিস্তা ব্যারাজ ঘেঁষে চলছে অবৈধ পাথর উত্তোলন

তাহমিন হক ববি, তিস্তা ব্যারাজ থেকে ফিরে ॥ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআইওয়ান) সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজে দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অচল কন্ট্রোল টাওয়ার, মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন চলাচলসহ নানাবিধ কারণে হুমকির মুখে পড়ে আছে। আর এটিকে পুঁজি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বেশ কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী কর্মচারী এবং সিন্ডিকেট সিবিএ নেতারা। এ অবস্থায় ব্যারাজজুড়ে ফাটল দেখা দেয়ায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আসামি ২৫ নবেম্বর থেকে ব্যারাজের ওপর দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নোটিস জারি করেছে। সূত্র মতে, বিস্তীর্ণ এলাকার জমিতে সেচ দিয়ে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে শুরু করা হয় নীলফামারীর ডালিয়ার তিস্তা নদীর ওপর ব্যরাজ নির্মাণের কাজ। স¤পূর্ণ দেশী প্রযুক্তিতে দেশের প্রকৌশলীরা ব্যারাজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেন। ব্যারাজ, বিভিন্ন অবকাঠামো, সিল্টট্রাফ ও বিভিন্ন ক্যানেল নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ১৫শ’ কোটি টাকা। ১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট ব্যারাজ নির্মাণ কাজ শেষ হলে এর প্রথম ভাগের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর জেলার ১৩ উপজেলার ১ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করে দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এতে বছরে ৪৫২ কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন আশা করা হয়। এই প্রকল্পের সুফল ইতোমধ্যে এতদাঞ্চলের কৃষকেরা ভোগ করছে। অভিযোগ উঠেছে তিস্তা ব্যারাজের কার্যক্রম অচল করার পাঁয়তারা এবং বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য একটি কুচক্রী মহল উঠে-পড়ে লেগেছে। ব্যারাজ ঘেঁষে শুরু করা হয়েছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন। ফলে মাটির তলদেশ থেকে তিলে তিলে গড়ে তোলা তিস্তা ব্যারাজটির অপারেটিং সিস্টেম সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সূত্র মতে, স্থানীয় প্রভাবশালী পাথর ব্যবসায়ী, সিবিএ নেতাসহ ব্যারাজের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এর সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর তিস্তা ব্যারাজ ঘেঁষে পুনরায় পাথর উত্তোলন শুরু করেছে ওই কুচক্রী মহলটি। এলাকাবাসী সূত্রে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে এক চিঠিতে দিনে ও রাতে সমানে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি প্রমাণ করে। সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা ব্যারাজের মূল অপারেটিং সিস্টেম ঘিরে একাধিক ভাসমান নৌকার উপর ভারি মেশিন স্থাপন করে নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এভাবে ব্যারাজ ঘেঁষে পাথর, বালু উত্তোলনে ব্যারাজটি ধীরে ধীরে অকার্যকর করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারি মেশিন বসিয়ে পাথর উত্তোলন করায় নদীর গতি যেমন পরিবর্তন হচ্ছে পাশাপাশি নদী রক্ষা বাঁধ দিয়ে পাথর পরিবহন করে নিয়ে যাওয়ায় চরম হুমকিতে পড়ছে বাঁধটি। শুক্রবারও সেখানে অবৈধ পাথর, বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়। দেখা যায় বেশ কিছু প্রভাবশালী ও সিবিএ নেতাকে। তাঁরা সাংবাদিক দেখে মুখ ঘুরিয়ে অন্যত্র সরে পড়েন। পাথর উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাঁরা কোন কথা বলতে পারবে না বলে জানিয়ে দেন। এ সময় ব্যারাজের দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা জানায়, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের ক্যাম্প ইনচার্জ আতাউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার তিস্তা ব্যারাজ ঘেঁষে অবৈধ পাথর, বালু উত্তোলনের জন্য ব্যারাজের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার ক্যাম্পের ইনচার্জ আতাউর রহমানকে শোকজ করা হয়েছে। ডালিয়া ডিবিশন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দোয়ানী শাখা কর্মকর্তা এসএম সুরতুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই শোকজপত্রে (স্বারক নম্বর অ-২/৫৪/১(২)) উল্লেখ করা হয়, তিস্তা ব্যারাজের উজান ও ভাটির নিষিদ্ধ এলাকায় নৌকাওয়ালা ও অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনার আনসার বাহিনী মাছ ধরতে ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে সহায়তা করে আসছে, যা আইনত অপরাধ ও চাকরি বিধি পরিপন্থী। এ ব্যাপারে তিস্তা ব্যারাজের আনসার ক্যাম্পের ইনচার্জ আতাউর রহমানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এমন কি তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কেপিআইওয়ানের আওতায় দেশের এই বৃহৎ সেচ প্রকল্পটির ২০ কিলোমিটার উজান ও ভাটি সংরক্ষিত এলাকা । এর মাঝে কেউ পাথর, বালু উত্তোলন করতে পারবে না বলে নোটিম জারি রয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তাদের হুমকির মাধ্যমে জিম্মি করে একটি মহল প্রভাব বিস্তার করে অবৈধভাবে পাথর, বালু উত্তোলন করছে। সূত্র বলছে, এর আগে অবৈধ পাথর, বালু উত্তোলন নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে নীলফামারীর ডিমলা থানায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু মামলাগুলো প্রভাবশালী মহল ধামাচাপা দিয়ে রাখায় পুলিশের পক্ষে কোন সহায়তা তারা পায়নি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দায়েরকৃত মামলা নিয়ে বেশ কিছু প্রভাবশালী ও ডিমলা থানার ওসির বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি যারা পাথর উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত নয় এমন কয়েক ব্যক্তিকে মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করা হচ্ছে। তিস্তা পাড়ের বেশ কিছু ব্যক্তি অভিযোগ করে জানায়, সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ জুলাই পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের সহকারী পরিচালক (নিরাপত্তা) হোসাইন মোঃ হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে ডিমলা থানায় (মামলা নং-১৭) খনি ও খনিজস¤পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন ১৯৯২ সালের ৫ ধারায় মামলা দায়ের করেছিল। মামলায় ১২ জন নামীয় ও বেশ অজ্ঞাত আসামি করা হয় শতাধিক ব্যক্তিকে। তাদের অভিযোগ, এই মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে যারা মেশিন চালায়নি বা ট্রলি ভাড়া দেয়নি তাদের মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে প্রতিজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় ২৫/৩০ হাজার করে টাকা। অপরদিকে গত ২৬ জুলাই ডিমলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা এটিএম আব্দুর রহমান তিস্তা নদীতে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করায় ২০ জনের নামে লিখিত একটি এজাহার থানায় দিলেও তা মামলা হিসেবে ওসি শওকত আলী আজ পর্যন্ত রেকর্ড করেননি। এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানায়, এক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা একজোট হয়ে মেশিন মালিক ও ট্রলি মালিকদের কাছ থেকে টাকা তুলে ভাগবাটোয়ারা করছেন। এসব টাকার ভাগ পাচ্ছেন ডিমলা থানার ওসি আলী, সিবিএ নেতা ও পাউবোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে, উত্তর খড়িবাড়ী ভাসানীর চর গ্রামের মৃত্যু জালাল ম-লের ছেলে আব্দুল করিম যাদু নিজেকে সাংবাদিক পরিচয়ে ২টি বোমা মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করেন। অথচ কথিত এই সাংবাদিক আব্দুল করিমকে মামলার আসামি না করে উল্টো তাঁকে দিয়েই অজ্ঞাত আসামিদের তালিকায় সরাসরি নাম না জড়ানোর জন্য মেশিন মালিকের কাছ থেকে চাঁদা উত্তোলন করা হয়।
×