ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিশেহারা রাজনীতিকের প্রলাপ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২২ নভেম্বর ২০১৪

দিশেহারা রাজনীতিকের প্রলাপ

বাংলায় দুটি শব্দ আছে, দিশারি ও দিশেহারা। দিশারি শব্দের অর্থ পথ প্রদর্শক, দিশেহারা শব্দের অর্থ দিগভ্রান্ত। রাজনীতিবিদরা দিশারি হবেন, এটাই আশা করে দেশের মানুষ। মানুষ যখন বিভ্রান্ত হবে, পথ ভুলে যাবে, তখন রাজনীতিবিদরা পথ দেখাবেন। তাদের কাছ থেকে মানুষ পাবে নতুন পথের সন্ধান। কিন্তু রাজনীতিবিদরাই যদি দিশেহারা হয়ে যান তাহলে কী হবে? রাজনীতিবিদরা কিভাবে কথাবার্তা বলেন বা বলবেন, তার একটা ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে। কিন্তু দিশেহারা রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা কেমন হয়? বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে দিশেহারা রাজনীতিবিদরা বাইরে অর্থাৎ জনসমক্ষে প্রলাপ বকেন। অন্দরমহলে হয়ত বিলাপ করেন তাঁরা। সাম্প্রতিক জনসভাগুলোতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তব্য অনেকটাই প্রলাপে পরিণত হয়েছে। এর ভেতর দিয়ে ক্ষমতার জন্য বিলাপও যে নেই, তা নয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার বেদনা কোনভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না তিনি। ফলে বিভিন্ন জনসভায় গিয়ে তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। নীলফামারী আর নাটোরের জনসভায় তাঁর বক্তব্য তো তা-ই প্রমাণ করে। নাটোরের জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে অবৈধ, অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক আখ্যায়িত করেই থেমে থাকেননি তিনি। খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা নব্য হিটলার। হিটলারি কায়দায় দেশ চালাচ্ছেন।’ তাঁর ভাষ্য মতে, ‘এই সরকার একঘরে হয়ে গেছে। তারা শুধু জনগণ থেকেই নয়, পৃথিবীর সব দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ দশম সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ পরিচালনায় সরকার গঠন করেছেন। সরকার যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দেশ চালাচ্ছে। দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা দেশ ও দেশের মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। সরকারের এই দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতাই খালেদা জিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। সরকার জনগণের কাছে যত দায়বদ্ধ থাকবে, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেÑসরকারের প্রতি জনগণের আস্থা তত বৃদ্ধি পাবে। সরকার জনগণের আস্থা অর্জন মানেই বিরোধী পক্ষের আস্থা কমতে থাকবে। যুদ্ধাপরাধী-জামায়াত ঘনিষ্ঠতা, জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টিসহ দলীয় আস্থার অভাব যে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনবিমুখ করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছেন। সংবিধান সমুন্নত রাখতে যা কিছু করা দরকার, শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচনে না আসা বিএনপির জন্য ছিল একটি বড় রাজনৈতিক ভুল, সেই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত এখন বিএনপিকে দিতে হচ্ছে। শুধু ক্ষমতা নয়, সংসদেরও বাইরে এখন বিএনপির অবস্থান। দেশের রাজনৈতিক ধারার মূল স্রোতে ফিরতে হলে বিএনপিকে যেতে হবে মানুষের কাছে। জনমানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে থাকতে হবে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচী। কিন্তু বিএনপির কোন কর্মসূচীতে জনগণের আস্থা নেই। বিগত নির্বাচনের আগে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে মানুষ হত্যায় নেমে গিয়েছিল জামায়াত-বিএনপি জোট। আদর্শগত দিক থেকে সমগোত্রের হওয়ায় জোটবদ্ধ হওয়া এই দুই রাজনৈতিক দলের নৃশংসতা দেখেছে দেশের মানুষ। ফলে বিএনপি জনগণের কাছে যেতে পারছে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে জনমানুষের প্রতি বিএনপি কখনও আস্থাশীল ছিলÑএমন কথা বলা যাবে না। জন্ম থেকেই বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন। কাজেই দলীয়প্রধান হিসেবে খালেদা জিয়াকে স্ট্যান্টবাজির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কারণ দিনের পর দিন কর্মসূচীর কথা বললেও এখন পর্যন্ত ‘নরম’ কিংবা ‘গরম’ কোন কর্মসূচীই দিতে পারেননি খালেদা জিয়া। শুকনো কথায় যেমন চিড়ে ভেজে না, তেমনি অসার কথায় রাজনীতির মাঠ গরম করা যায় না; আন্দোলন দূরঅস্ত। জনবিচ্ছিন্ন বিএনপিকে জনসম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া। জনসভার নামে জনসমর্থন যাচাই করে বেড়াচ্ছেন তিনি। মঞ্চে উঠে মানুষের মুখের দিকে তাকালে মনের ভাষা বুঝতে পারা যায়। সম্ভবত সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। আর সে কারণেই রোজার ঈদের পর কোরবানির ঈদ চলে গেলেও কোন কর্মসূচী ঘোষণা করতে পারেননি তিনি। অবশ্য কোন্ বছরের ঈদের পর তিনি কর্মসূচীর ঘোষণা দেবেন তা কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি। কাজেই সময়ক্ষেপণ ছাড়া বিকল্প কিছু নেই তার কাছে। জনসভার নামে সে কাজটিই তিনি করছেন। আর তা করতে গিয়েই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে ‘নব্য হিটলার’ বলেছেন। তাঁর এই শব্দবদ্ধ যে জনগণ ‘খায়নি’ তা উচ্চারণ মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর কথা যে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি সেটা বুঝতে পেরেই তিনি দেশ ছেড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘এই সরকার একঘরে হয়ে গেছে। তারা শুধু জনগণ থেকেই নয়, পৃথিবীর সব দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ সম্প্রতি জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ, কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ), ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ), আইটিইউসহ সব নির্বাচনেই বাংলাদেশ সাফল্য পেয়েছে। কূটনীতিকদের মতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ও আইটিইউতে নির্বাচন সত্যিই বাংলাদেশের জন্য বড় সাফল্য। তবে নিঃসন্দেহে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে সিপিএ ও আইপিইউ নির্বাচন। কারণ বাংলাদেশের যে সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে এত আলোচনা-সমালোচনা, সেই সংসদের প্রতিনিধিরাই বিদেশীদের প্রত্যক্ষ ভোটে জয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ এই সংসদের প্রতিনিধিদের প্রতি ওই বিশ্বে সংসদভিত্তিক ফোরামের বেশিরভাগ সদস্য সমর্থন দিয়েছেন। কূটনীতিক মহলের মতে, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ গঠনমূলক ভূমিকার জন্য বিশ্বে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। এছাড়া বাংলাদেশ ওই নির্বাচনগুলোর জন্য বিশ্বে তার কূটনৈতিক কাঠামোকে সদ্ব্যবহার করেছে। এটা সবারই জানার কথা, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠান আয়োজন করে তার প্রার্থিতার কথা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরেছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিপিএ ও আইপিইউর গুরুত্ব অনেক। এক কূটনীতিকের বক্তব্য তুলে ধরে ঢাকার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনের আগে ঢাকায় এক ইউরোপীয় শীর্ষ কূটনীতিক বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে তাঁদের নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অথচ ওই ইউরোপীয় কূটনীতিকই নির্বাচনের পর বলেছেন, সম্পর্ক আগের মতোই আছে।’ এর নেপথ্যে কারণও আছে। ওই নির্বাচন কেন প্রয়োজন ছিল, নির্বাচন না হলে কি হতে পারতÑ এ সব বিষয় বাংলাদেশ বিদেশীদের কাছে সফলভাবে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামের বৈঠকে অংশ নিতে মিয়ানমার, জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সফর করেছেন। এ সব সফরে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। প্রতিবেশী ভারতে ক্ষমতার পালাবদলের পরও সম্পর্কে স্বাভাবিকতা এবং আরও নতুন গতি সঞ্চার বাড়তি স্বস্তি এনেছে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য। ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গড়েছেন এবং তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা দেশ বাঁচিয়েছেন’Ñনয়াদিল্লী ও নিউইয়র্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এমন উক্তি শেখ হাসিনার সরকারের জন্য বাড়তি পাওনা। ভারতে বিজেপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বিএনপির ভেতরে যে উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিতে তা স্তিমিত হয়ে গেছে। কাজেই এটা এখন স্পষ্ট, সরকার ঘরে-বাইরে কোথাও একঘরে হয়নি। বরং বিদেশে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করে দেশেও সরকারের জনসমর্থন বেড়েছে। আর সে কারণেই বলা যেতে পারে- বিএনপি চেয়ারপার্সন ইদানীং জনসভায় বক্তৃতার নামে যা বলছেন, তা এক ধরনের প্রলাপ বকারই শামিল। অদূর ভবিষ্যতেই এটা হয়ত হবে ‘ক্ষমতার জন্য বিলাপ’। বিলাসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভবিতব্য যে এটাই, তা নিশ্চয় নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের বহুমুখী সাফল্যে দিশা হারিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তাঁর বক্তব্য তাই এখন দিশেহারা রাজনীতিকের প্রলাপের মতো শোনাচ্ছেÑঅচিরেই যা হয়ত বিলাপে পরিণত হবে। কারণ তাঁর ওই বক্তব্যে কোন সারবস্তু নেই। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
×