ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ আমাদের বিস্ময় বালক বালিকা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২৩ নভেম্বর ২০১৪

একুশ শতক ॥ আমাদের বিস্ময় বালক বালিকা

১৫ নবেম্বরের জাতীয় পত্রিকাসমূহের প্রথম পাতার একটি খবর নিশ্চয়ই অনেককে চমকে দিয়েছে। খবরে পাকিস্তানী-ব্রিটিশ পিতামাতার সন্তান আয়ান কোরেশীকে কম্পিউটারের বিস্ময় বালক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের এই শিশুর বয়স ছয় বছর। এরই মাঝে সে মাইক্রোসফটের পেশাদারী পরীক্ষা (এমসিপি-মাইক্রোসফট সার্টিফাইড প্রফেশনাল) পাস করেছে এবং নিজে নিজেই জটিল নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে সক্ষম হচ্ছে। সে এখন আইটি পরামর্শক হিসেবে কাজ করে। সে স্বপ্ন দেখে যুক্তরাজ্যে সিলিকন ভ্যালি বানানোর। খবরটি বিবিসি পরিবেশন করার পর আমাদের দেশের অনেক পত্রিকা তা প্রকাশ করেছে। অনলাইনে খবরটি দেখার পর একটি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে মজার মজার মন্তব্য পড়লাম। একজন মন্তব্য করেছে যে, মাইক্রোসফটের পরীক্ষায় পাস করা তেমন কঠিন কোন কাজ নয়। এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলো ইন্টারনেটে পাওয়া যায় এবং তার জবাব মুখস্থ করলে এর উত্তরও সহজেই দেয়া যায়। তবে বেশির ভাগ পাঠক কোরেশীর প্রশংসা করেছেন। ছয় বছর বয়সে পরীক্ষায় পাসের চাইতেও বড় বিষয় যে, সে রীতিমতো প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে। যখন তার খেলনা নিয়ে খেলার কথা তখন তাকে দেখা গেল জটিল তারের জালের পাশে। ছবিটি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত মানুষ বা পিতা-মাতাদের মুগ্ধ করবে। অভিনন্দন আয়ান কোরেশী। খবরটি পড়েই আমার চোখের সামনে বাংলাদেশের এক শিশুর কথা মনে পড়ল। ওর নাম রূপকথা। ওর বয়স সম্ভবত এখনও দশ বছর হয়নি। আমি স্মরণ করতে পারি যে, বছর কয়েক আগেই কোলে করে তার মা আমার আরামবাগ অফিসে রূপকথাকে নিয়ে এসেছিল, যখন ছেলেটি কম্পিউটার ব্যবহার করার দক্ষতা প্রদর্শন করেছিল। আমি তাকে কম্পিউটার অনুষ্ঠানে দেখানোর কথা ভেবেছিলাম। তবে হয়ে ওঠেনি। আমার কাছে মনে হয়েছিল রূপকথার দক্ষতা একেবারে ব্যতিক্রম কিছু নয়। আজকালের শিশুরা সবাই প্রায় রূপকথা। এরপর নানা মিডিয়াতে রূপকথার খবর ছাপা হয়েছে। কেউ কেউ তাকে দুনিয়ার কনিষ্ঠতম প্রোগ্রামার বলারও চেষ্টা করেছে। রূপকথার মা তাকে এ রকমই বিস্ময় বালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে আমি স্মরণ করতে পারিÑ এমন এক বিস্ময় বালকের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম পরিচিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেই বছর মে মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কম্পিউটার নামক একটি অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। প্রথম অনুষ্ঠানটি হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার নিয়ে। একনাগাড়ে সেটি ২০০১ সাল পর্যন্ত চলে। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ২০০১ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। আমার গায়ে আওয়ামী গন্ধ ছিল বলে বিটিভি সেটির প্রচার বন্ধ করে দেয়। বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে আবার ২০০৭ সাল থেকে সেটি নিয়মিত প্রচার হতে শুরু করে। সেটি এখনও চলছে। এই অনুষ্ঠানে ১৯৯৭ সালেই আমি দেখিয়েছিলাম যে, সাড়ে তিন বছরের শিশু বিজয় জব্বার কম্পিউটার দিয়ে খেলে। কম্পিউটারে পড়াশোনা করা থেকে শুরু করে এটি ব্যবহার করে লেখালেখি, ছবি আঁকা, গান শোনা, সিনেমা দেখাসহ অনেক কাজ করে। কম্পিউটার দিয়ে তার লেখাপড়া দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। সেই শিশুটি বাংলাদেশের বহু মানুষকে কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। তার মা তাকে কম্পিউটারে ছড়া শুনিয়ে খাবার খাওয়াতেন। তার সেই লেখাপড়ার বিষয়টি এতদিনে আমার হাতে মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার এবং মাল্টিমিডিয়া শিক্ষাব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ওর শৈশবের সফটওয়্যারগুলো দেখেই ১৯৯৯ সালে আমি আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল গড়ে তুলি। যে কারও সঙ্গে দেখা হলেই মানুষ আমার কাছে বিজয় জব্বার সম্পর্কে জানতে চাইত। সেই শিশুটি এখন কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করছে। এখন তার জ্ঞান অনেক। কিন্তু সাড়ে তিন বছর বয়সে তার কম্পিউটার ব্যবহার করার দক্ষতা আমাদের সকলকেই মুগ্ধ করেছিল। এখন মনে হচ্ছে মিডিয়াকে ব্যবহার করলে বিজয়কেই আমি আয়ান বা রূপকথার চাইতেও বড় সেলিব্রিটি বানাতে পারতাম। আমার মনে হয় আমি এরই মাঝে আইসিটিতে আরও অনেক সেলিব্রিটি দেখানোর সুযোগ মিস করেছি। আমাদের বিজয় ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জেসমিনের একটি চৌদ্দ বছরের মেয়ে আছে। ওর নাম পরমা। ৮ বছর বয়স থেকে ওকে আমি চিনি। তখন সে কদাচিৎ তার মার কম্পিউটারে গেম খেলত। ছয় বছর যাবত সে কম্পিউটারের সঙ্গে বসবাস করে। বিরামহীন দেড় এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ নিয়ে তার ২৪ ঘণ্টা কাটে। ওর টিভি দেখা হোক, গেম খেলা হোক, সিনেমা দেখা হোক বা হোক লেখাপড়া; সবটাই কম্পিউটারনির্ভর। আমরা যখনই কোন সমস্যায় পড়ি তখনই ওকে খুঁজি। আমাদের কম্পিউটারের-ইন্টারনেটের নেটওয়ার্কের সমস্যার সমাধান করে পরমা। ডাউনলোডতো একমাত্র পরমাই করে থাকে। ওর আইপ্যাড আছে। আমি লক্ষ্য করেছি আইপ্যাডের সর্বোচ্চ ব্যবহার সে করে থাকে। এতে ভিডিও তোলা হোক, ছবি দেখা হোক, গেম খেলা হোক বা হোক নেট ব্রাউজিং; বালিশের তলায় রেখেই সে সব কাজ সম্পন্ন করে। ওর ফোনটা এন্ড্রয়েড। ওয়াইফাই দিয়ে ভাইবার বা হুয়াটসএ্যাপ ব্যবহার তো আছেই, আছে এন্ড্রয়েডের এ্যাপ নিয়ে সময় কাটানো। সে মাইক্রোসফট সারফেস-প্রোও ব্যবহার করেছে। এগুলো আমরা কেউ ব্যবহার করতে পারি না। এ সব প্ল্যাটফর্মে আমাদের বাংলা বা শিক্ষামূলক সফটওয়্যার টেস্ট করতে পরমাই একমাত্র ভরসা। ওর মার বা আমার আইসিটি বিষয়ক কিছু লাগলে পরমাকেই বলতে হয়। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় সে কম্পিউটারের প্রজেক্ট করে। এ্যাকশন স্ক্রিপ্ট দিয়ে সে শিক্ষামূলক সফটওয়্যার বানায়। বিজয় শিশুশিক্ষার জন্য সে তার নিজের ভয়েস নিজে রেকর্ড করে। অডিশন দিয়ে নিজে এডিট করে। যদি অন্য কারও ভয়েস নিতে হয় তবে ওর মা পরমাকেই দায়িত্ব দেয়। মাল্টিমিডিয়া কনটেন্টস তৈরির জন্য পরমা ছাড়া আমাদের কোন গতি নেই। তাহা আন্টি (বিজয় শিশুশিক্ষার প্রোগ্রামার) যতদিন পরমার সঙ্গে থাকত ততদিন আন্টির সঙ্গে এ সব বিষয় নিয়ে প্রচুর সময় কাটত তার। ইচ্ছে করলে পরমাকেও আমরা সেলিব্রিটি বানাতে পারতাম। তবে আমাদের ধারণা, বাংলাদেশের ১১ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক, সাড়ে চার কোটি ইন্টারনেট গ্রাহক বা অন্তত কোটিখানেক কম্পিউটার ব্যবহারকারীর মাঝে লাখ লাখ পরমা আছে। আমরা এটিও মনে করি, ওরা সবাই আয়ান, রূপকথা, বিজয় বা পরমা হতেই পারে। বিবিসি ওদের নিয়ে খবর বানালে ওরা বিশ্বের সেলিব্রিটি হতে পারে আর বাংলাদেশের মিডিয়া তাদের জাতীয় সেলিব্রিটি বানাতে সক্ষম। আমার জানা আরও এক সেলিব্রিটি আছে। ওর কথা আমাকে বলতেই হবে। আমি স্মরণ করতে পারি ২০০১ সালের কথা। জয়পুরহাটে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া ও আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল ছিল। প্রায় প্রতিমাসেই আমি অন্তত একবার জয়পুরহাট যেতাম। আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিতাম। বস্তুত ৩০টি ক্যাম্পাসের সবটিতেই যেতাম। পুরো মাসটাই বস্তুত গাড়ির চাকার ওপর কাটত। সেদিন আমি আনন্দ মাল্টিমিডিয়ার ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিচ্ছিলাম। ক্লাস শেষে ক্লাস নাইনে পড়া একটি ছেলে আমাকে বলল, স্যার আমি আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাব। শর্ত হচ্ছে, সেটি দেখে আপনি আমাকে মারতে পারবেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে দেখাও। সেই ছেলে রিফাত উন নবী আমাকে তার কম্পিউটারটি চালু করে দেখালÑ বিজয় বাংলা সফটওয়্যার চালু হচ্ছে কিন্তু সেখানে আমার ছবির বদলে ওর ছবি দেখাচ্ছে। আমি ওকে মারব কী? মুগ্ধ হলাম। জানতে চাইলাম কিভাবে করলে। সে জানাল নিজে নিজে শিখেছে সে। মফস্বল শহরের সেই রিফাত এখন আমাদের জাতীয় জীবনের এক হিরো। সেই রিফাত নাইনে পড়ার সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পর্যন্ত বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের তরুণদের এমন সফলতার কাহিনী আমি হাজার হাজার বলতে পারব। একেবারে সর্বশেষ একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করছি। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কোন টিভি চ্যানেল কিছু করতে চাইলেই আমার ডাক পড়ে। কখনও নিউজবাইট, কখনও রেকর্ডিং বা কখনও লাইভ অনুষ্ঠান। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করা এই কাজ জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। পত্রিকার পাতায় তরুণ সাংবাদিকরা প্রায়শই নিউজ করতে একটা কমেন্ট খুঁজে বেড়ায়। এই বয়সে এ সব জ্বালাতন একেবারেই খারাপ লাগে না। তবে আমি অনেক বেশি আনন্দ পাই শিশু-কিশোরদের নিয়ে যদি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কোন অনুষ্ঠান করা হয় তাতে। আইসিটি ফেয়ার বা বিজ্ঞান মেলা কিংবা স্কুলের কোন অনুষ্ঠান আমাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। নানা ধরনের কর্মকা-ের মাঝে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও যেতে হয়। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি থাকাকালে কাজটা একটু বেশি করতে হতো। ইদানীং সেটি কিছুটা কমলেও একেবারে থেমে যায়নি। প্রায়ই কেউ না কেউ কোন না কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়। গত ১৪ নবেম্বর শুক্রবারের জন্যও একটি আমন্ত্রণ পাই। ঢাকার ধানম-ির কারডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল একটি আইসিটি ফেয়ারের আয়োজন করে। আমি অবশ্য কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেন ওরা আমাকে ডেকেছিল। পরে জেনেছি যে, স্কুলটির অধ্যক্ষ আমার পূর্বপরিচিত। প্রথমে ওরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেতে বলেছিল, পরে সমাপনীতে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের নতুন সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদারও আমন্ত্রিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সচিব মহোদয় আসতে দেরি হবে জেনে আমি মেলাটি ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করি। অধ্যক্ষ নিজামউদ্দিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফেয়ারে আসা তাঁর স্কুল ও অন্য স্কুলগুলোর বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখান। ওখানে প্রথমেই আমি দেখি কারডিফ স্কুলেরই ক্লাস সেভেনে পড়া অমি আশরাফের দুটি প্রকল্প। একটি প্রকল্পে অমি একটি নেট ব্রাউজার দেখিয়েছে। অন্যটিতে সে স্পাই সফটওয়্যার দেখিয়েছে। ডটনেট ২০১৩ সালে তৈরি ওর দুটি সফটওয়্যার দেখে আমি চোখে আনন্দাশ্রু রাখতে পারিনি। এ সব সফটওয়্যার মাইক্রোসফট বা গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান বানায়। এরপর শিশু জুবাইদার প্রেজেন্টেশনসহ যে কয়টি প্রকল্প দেখেছি তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এমন মুগ্ধতার সঙ্গে আমি প্রতিদিন পরিচিত হই। দেশের আইসিটি খাতে, ডিজিটাল কেন্দ্র থেকে শুরু করে আউটসোর্সিং পর্যন্ত হাজার হাজার বিস্ময় বালক বা বালিকার সন্ধান আমি দিতে পারি। গৃহিণী থেকে শুরু করে প্রোগ্রামার পর্যন্ত এমন অনেক মানুষকে আমি চিনি যাঁরা দেশটাকে বদলে দিচ্ছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই বালক-বালিকাদের পরিচর্যা করার কাজটি আমরা রাষ্ট্রীয় বা জাতিগতভাবে করতে পারি না। এখনও দেশে এমন পরিবেশ তৈরি হয়নি যে, মেধার চর্চা যারা করে তারা নিজেদের সম্মানিত বোধ করতে পারে। এখনও দেশে কোন প্রকারের মেধার মর্যাদা বা সুরক্ষা নেই। আমাদের আরও দুর্ভাগ্য যে, কোন এক সময়ে ওরা বাধ্য হয়ে এই দেশ ছেড়ে বিদেশে যাবে। এই মেধাবীদের সেবা আমার দেশ পাবে না, পাবে টাকাওয়ালা কোন জাতি। আমার অনুরোধ, অনুগ্রহ করে খালে-বিলে টাকা না ঢেলে বিজয়-পরমা-রিফাত-অমি-জুবাইদাদের পাশে দাঁড়ান। প্রথম রচনা ২২ নভেম্বর ১৪ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥
×