ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশী সাহায্য এনে অঢেল সম্পদের মালিক জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২৬ নভেম্বর ২০১৪

রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশী সাহায্য এনে অঢেল সম্পদের মালিক জঙ্গীরা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ পার্বত্য আলীকদমের গহীন অরণ্যে সশস্ত্র গ্রুপের নেতৃত্ব প্রদানকারী, রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসযজ্ঞের মূল হোতা ও মৌলবাদী চক্রের অন্যতম সহযোগী ভয়ঙ্কর জঙ্গী ছালামতউল্লাহ গোয়েন্দা জালে আটক হওয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গারা অত্যন্ত খুশি। ছালামতের সহযোগী অন্য জঙ্গীরা গা ঢাকা দিলেও শরণার্থী ক্যাম্প ও বস্তির রোহিঙ্গারা বেজায় খুশি বর্তমানে। কেননা ইতোপূর্বে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশে মৌলবাদী গ্রুপের লোকজনের সঙ্গে জঙ্গী ছালামতউল্লাহর নির্দেশে শরণার্থী ক্যাম্প থেকে জোর করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে যেত সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। জামায়াত-বিএনপির আন্দোলনে রোহিঙ্গারা না গেলে জঙ্গী ছালামতের হুকুমে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসত নিষ্ঠুর নির্যাতন। আবদুল কাদের নামে এক বৃদ্ধ রোহিঙ্গা জানায়, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে সহিংস ঘটনায় উখিয়া কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া-লেদা ক্যাম্প থেকে অসংখ্য রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার নির্দেশে। তিন গ্রামবাসী হত্যা শেষে পালিয়ে আসার সময় পুলিশ ১০ রোহিঙ্গাকে আটকও করেছিল। তাদের অনেকে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। বখাটে রোহিঙ্গা যুবকদের নিয়ে আলীকদমের গহীন অরণ্যে অস্ত্র পরিচালনা, ক্যারাতেসহ গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে আসছিল জঙ্গী ছালামত। আলীকদম ছাড়াও ইসলামপুরসহ একাধিক স্থানে পাহাড়ে মাটির নিচে তার কাছে বহু ভারি অস্ত্র রয়েছে বলেও অসমর্থিত খবর পাওয়া গেছে। বেআইনী ও দেশদ্রোহী কাজে দেশের একাধিক ইসলামী রাজনৈতিক দলসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং জঙ্গীদের সঙ্গে হরদম যোগাযোগ ছিল তার। ছালামতের সঙ্গে সৌদি আরবের রোহিঙ্গা নেতা আবু সালমানও (মোঃ আলম) আটক হন। গত বছর রোহিঙ্গাদের জন্য ছালামত উল্লাহর মাধ্যমে সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। ঐ টাকার সিংহভাগই আত্মসাত হয়ে যাওয়ায় সরেজমিনে দেখে ও রোহিঙ্গা আরএসও ক্যাডারদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে আগামীতে বাজেট ঠিক করতে ঐ মোঃ আলম সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে আসেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের নামে মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ আমেরিকা ভিত্তিক বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম মুসলিম দেশ, দাতা ও দাতব্য সংস্থার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অনুদান ও ত্রাণ নিয়ে আরাকান বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও’র জঙ্গীরা আত্মসাত করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে কক্সবাজার ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যদিও ঐ সাহায্য আনা হয়ে থাকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নামে। বাস্তবে সাধারণ রোহিঙ্গারা তার সিকি ভাগও পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরে অভিজাত হোটেলসহ অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে এক শ্রেণীর রোহিঙ্গা জঙ্গী। আরএসও’র সংশ্লিষ্ট এনজিও ইন্ট্রিগ্রেটেড হিউম্যান এপ্রোচ, মানবকল্যাণ, করুনা, সমন্বয় হীনতায় মানবিক উদ্যোগ, ওয়ামী ও মানব সেবা ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মসজিদ, রিংওয়েল স্থাপন করে ফটোসেশনের মাধ্যমে চিত্র সংগ্রহ করে বহির্বিশ্বে প্রেরণ করে থাকে আরএসও জঙ্গীরা। পরবর্তীতে ঐসব এনজিও সংস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসা হয় বিপুল অর্থ। ওইসব ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তার্কিশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, তুর্কি ডিয়ানাত ফাউন্ডেশন, কুয়েতের আবদুল্লাহ আল নূরীর চ্যারিটি, ইন্টারন্যাশাল ইসলামিক চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশন, আবদুল্লাহ আল মুতাওয়া চ্যারিটি ফাউন্ডেশন, মুয়াল্লিম আল জামিল, আরব আমিরাতের সারজাহ চ্যারিটি হাউস, একই দেশের দাতা আবদার রহমান মোহাম্মদ আত্ তামিমী, ওমানের দাতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল ফায়মী ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ আমেরিকা ভিত্তিক বিভিন্ন মুসলিম দাতা ও দাতব্য সংস্থার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অনুদান ও ত্রাণ নিয়ে রোহিঙ্গা জঙ্গীরা আত্মসাত করে আসছে প্রতিনিয়ত। বিদেশী সাহায্যের অঢেল টাকায় কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় রোহিঙ্গা জঙ্গীদের অনেকে আলিশান বাড়ি, একাধিক প্লটের ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছে ওসব জঙ্গীরা। সূত্র জানায়, মোবাইলে কথা-বার্তা ও প্রেরিত ম্যাসেজ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে জেনে যাচ্ছে বলে ছালামতউল্লাহর নির্দেশে মাস খানেক আগে থেকে ঐ কৌশল পাল্টিয়েছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা আরএসও ক্যাডাররা। বর্তমানে রোহিঙ্গা জঙ্গী ও ইসলামী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ই-মেইলের মাধ্যমে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জঙ্গীর বাসায় ও টেকনাফ-উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগসহ অসংখ্য ল্যাপটপ। বর্তমানে টেকনাফ ও উখিয়ায় ২টি শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়াও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে রয়েছে বেশ কিছু জঙ্গী নেতা। আর এদের পুঁজি করে ফায়দা হাসিল করছিল জঙ্গী ছালামত, আয়াছ, আবু ছালেহ, আবু আবদুল্লাহ, শাপলাপুরের মৌলভী আজিজ, জুবায়ের ও ঈদগাঁওর বিএনপি নেতা আবুল কালাম মেম্বারসহ অনেকে। তারা সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা যুবকদের প্রলুব্ধ করে প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিতে আরএসও-ওয়ামির অর্থায়নে পরিচালিত বহু মাদ্রাসার ছাত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিয়ে বর্মী মৌলভীরা তাদের সমর প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। কৃতকার্য হলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বহির্বিশ্বে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ওইসব রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১৯৯২ সালে শরণার্থী হিসেবে এদেশে পালিয়ে এসে মৌলভী ছালামতউল্লাহ রামু ধেছুয়াপালংয়ের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। কিছুদিনের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনে (আরএসও) থোয়াইঙ্গাকাটা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে নেতা বনে যায়। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রশ্রয় ও জঙ্গীপনার নেতৃত্ব দেয়া শুরু করে। আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপে যোগ দিয়ে তার সন্ত্রাসী কর্মকা-, বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হয়ে অতি তাড়াতাড়ি আরএসও গ্রুপের সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়। রামুর এক সাবেক চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় অস্ত্র ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে হাত রেখে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ভারতের প্রসিদ্ধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নিকট পরিচিত মুখ ও আস্থাভাজন হয়ে উঠে। ১৯৯৪ সালে হিমছড়ি-রেজু নদীর মধ্যবর্তী পাহাড়ে আরএসও’র ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে নেতৃত্বদানের পাশাপাশি ১৯৯৫ সালে আল হারামাইন নামে একটি এনজিওতে চাকরি ও পটিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে দওরা পাস করে। ২০০০ সালে আ’লীগ সরকারের আমলে ঐ এনজিও আল হারামাইন নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে ছালামতউল্লাহ এনজিও কর্মকর্তাদের হাত ধরে মদিনায় চলে যায়। সেখানে আল হারামাইনের হয়ে জঙ্গীপনায় প্রশিক্ষণ ও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করার পরিকল্পনায় দেশে এসে চট্টগ্রামের খুলশিতে আরএসও’র নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামিক সর্বোচ্চ দাওয়া সেন্টারে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেয়। ২০০৬ সাল থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের (আরএসও) শক্তিশালী করার অপতৎপরতা চালায়। ২০০৯ সালে আরএসও’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় স্বরণ আবাসন প্রকল্পে ৩নং প্লট কিনে সেখানে ভবন নির্মাণ করে। ঐ ভবনে সৌদি, আফগান ও পাকিস্তান থেকে আগত লোকজনদের নিয়ে বিভিন্ন সময় গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন ঐ আরএসও নেতা ভয়ঙ্কর জঙ্গী ছালামতউল্লাহ। একই বছর জেদ্দায় রোহিঙ্গা জঙ্গীদের নিয়ে গঠিত আল মোস্তাকবেল আরাকান নামে জঙ্গী সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে অঢেল অর্থ সংগ্রহ করে।
×