ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একে একে চলে যাচ্ছেন মেধাবীরা মুক্তবুদ্ধি চর্চায় শূন্যতা

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

একে একে চলে যাচ্ছেন মেধাবীরা মুক্তবুদ্ধি চর্চায় শূন্যতা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘আমার একটা কথা আছে’। কিন্তু শেষ কথাটি আর বলা হলো না। শেষ কথাটি কি ছিল? কি বলতে চেয়েছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তা জানার আফসোস রয়ে যাবে হয়ত অনন্তকাল। প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বেঙ্গল উৎসবে বক্তব্য রাখেন তিনি। বক্তব্য শেষে ফের বলতে চেয়েছিলেন শেষ কথাটি। বলা হয়নি। হঠাৎ করেই মঞ্চে লুটিয়ে পড়েন খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পী। এভাবেই যে তিনি চলে যাবেন কেউ ভাবেনি। কল্পনাও করেনি। দেশপ্রেমিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই মানুষটির কাছে আরও প্রাপ্তি ছিল দেশের। সময়ই বলছে তাঁর যাবার সময় হয়নি। তবুও হাজারও মানুষ শ্রদ্ধা-ভালবাসায় তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন। ফেলেছেন অশ্রু। মনে মনে বার বার, হাজারবার বলেছেন, ‘যেখানেই থাকো ভাল থেকো’। এভাবেই একে একে চলে যাচ্ছেন দেশের খ্যাতিমান মানুষগুলো। শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ও দেশপ্রেমিক মানুষের। সৎ সাহস নিয়ে ভাল কাজ করা। ভাল কথা বলা। ভাল উদ্যোগে স্বাগত জানানো। গঠনমূলক সমালোচনা। কর্মে, চিন্তা ও মননে বাংলাদেশকে নির্মোহভাবে ধারণ করা। ঠিক এখানেই যেন সুতোর টান লাগতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে মেধার সঙ্কটও দেখা দিচ্ছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, ইতিহাস চর্চা, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ, বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে সবখানেই যেন ধাক্কা আসছে। যাঁরা বিদায় নিচ্ছেন তাঁদের বিকল্প হিসেবেও মেধার বিকাশ ঘটছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টো। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষাকে ধারণ করার বিপরীতে আগ্রাসন শুরু হয়েছে। যার প্রতিবাদ ও সমালোচনা করার মতো নির্ভরযোগ্য মানুষের সংখ্যা কমছে। ইতিহাস বিকৃতি রোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আলোকিত মানুষগুলোর কোন বিকল্প ছিল না। রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ইতিহাস বিকৃতিও চলছে সমানতালে। এতে সত্য চাপা পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালাচ্ছে একটি চক্র। এ সবকিছু রোধের ভাষা যেন স্তিমিত হচ্ছে দিন দিন। বলতে গেলে বটবৃক্ষে ডাল কমছে। গাছের ফাঁক গলিয়ে আসছে প্রখর রোদ। ২৯ নবেম্বর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী। রাত সোয়া আটটার দিকে রাজধানীর কাওরানবাজারে বাস চাপায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর এই অকাল বিদায় দেশের সাংবাদিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রেই শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। নীরবে-নিভৃতে চলে যান খ্যাতিমান সাংবাদিক এবিএম মূসাও। এবিএম মূসার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। সাংবাদিকতায় বর্ণময় অভিজ্ঞতা রয়েছে এবিএম মূসার। এ পেশায় তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকেছেন প্রায় ৬০ বছর ধরে। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফের মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন মূসা। ইংরেজী সাংবাদিকতায় এবিএম মূসা একটা নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরীও আর নেই। ৮৮ বছর বয়সে মারা যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস এই অধ্যাপক। গত বুধবার অক্সফোর্ডের নিজ বাড়িতে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ১৯২৬ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেখানেই কাটে তাঁর স্কুলজীবন। ১৯৪৮ সালে পরিবারের সঙ্গে তিনি ভারতে চলে যান। কলকাতা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস ও বাংলার ইতিহাস গবেষণায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় বই লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঙালনামা, রোমন্থন, ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা। ২০০৭ সালে তিনি ভারত সরকারের সম্মানসূচক পদ্মভূষণ উপাধি পান। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন তপন রায় সম্পর্কে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘তিনি আমাদের সময়কার ইতিহাসবিদদের মধ্যে একজন প্রধান লেখক। তিনি সারা ীবন অবিভক্ত বাংলার ও উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর চিন্তাধারা ছিল খুবই সূক্ষ্ম। তাঁর চিন্তাধারায় আমি ও আমার মতো অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। আমাদের দুইজনেরই পূর্ববঙ্গের শেকড়ের প্রতি টান ছিল’। শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও বিদায় নেন অনেকটা দুঃসময়ে। যখন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি অস্থির সময় চলছে ঠিক তখন সবাইকে ছেড়ে চলে যান তিনি। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর গঠনমূলক দিকনির্দেশনা চলমান সঙ্কটকে হয়ত প্রশমিত করতে পারত। খ্যাতিমান এই শিক্ষাবিদের প্রয়াণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত স্মরণসভায় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘তিনি দুই হাতে কবিতা লিখতেন। অনুবাদ করতেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করে নিজেকে দেশের একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র অহঙ্কার ছিল না। সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন দেশপ্রেমিক।’ জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা করে যিনি আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে সারাজীবনের জন্য স্থায়ীভাবে সম্মানের ও গৌরবের আসনে বসিয়েছিলেন তাঁর হঠাৎ করে চলে যাওয়া যেন বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি, যা পূরণ হবার নয়। কিছুতেই না। খ্যাতিমান এই স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক স্বরণসভায় বলেন, দেশ, জাতি ও মুক্তিযুদ্ধকে কতটা গভীরভাবে আত্মায় ধারণ করলে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মতো একটি অসাধারণ স্মৃতিসৌধের নকশা করতে পারা যায় তিনি ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নিজের সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে দেশপ্রেমের অসাধারণ সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন তিনি। চলতি বছরের আট অক্টোবর চিরবিদায় নেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। অষ্টাশি বছরের জীবনের শেষ পর্যন্ত সাম্যবাদের লড়াই চালিয়ে চিরবিদায় নেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এই সংগঠক। সারা বাংলাদেশ যাকে চেনে ভাষা মতিন নামে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মতিন। ৪ অক্টোবর থেকে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ধুবলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই নিজের দেহ তিনি দান করে দিয়ে গেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য, চোখ দান করে গেছেন সন্ধানীকে। বাস্তবতা হলো মৃত্যুর পরও দেহ দান করে প্রমাণ করে গেছেন দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ যেন মেনে নেয়ার মতো নয়। দেশ- বিদেশের লাখো কোটি ভক্ত-অনুরাগী তাঁকে খুঁজে ফিরে। হয়ত চীরদিনই তিনি বেঁচে থাকবেন ভক্তদের মাঝে। ২০১৩ সালের ৭ নবেম্বর চিরবিদায় নেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক আবদুর রশীদ ভূঁইয়া। একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ ১৯ অক্টোবর হঠাৎ করেই পরপারে চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ ১৯২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ড. সালাহউদ্দীন আহমেদ ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে কর্মরত অবস্থায় সালাহউদ্দীন আহমদসহ অন্য শিক্ষকরা ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে উৎসাহিত করতেন। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর সেখানে তিনি ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি ওই বিভাগের রিডার ও প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে বর্ণাঢ্য অধ্যাপনা জীবন শেষে ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও কয়েক বছর সংখ্যা অতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-সোশাল আইডিয়াস এ্যান্ড সোশাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল ঃ ১৮১৮-১৮৩৫, বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম এ্যান্ড দ্য এমারজেন্স অব বাংলাদেশ ঃ এ্যান ইনট্রোডাকটরি আউটলাইন, হিস্ট্রি এ্যান্ড হেরিটেজ ঃ রিফ্লেকশনস অন সোসাইটি পলিটিক্স এ্যান্ড কালচার অব সাউথ এশিয়া প্রভৃতি। ২০১১ সালে জাতীয় অধ্যাপক হন সালাহউদ্দীন আহমদ। যাকে বলা হয় ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী। খ্যাতিমান এই ব্যক্তির মুত্যুতে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘একটি জাতি যখন ইতিহাস বিকৃতির খেলায় মেতে থাকে, সেখানে তাঁর মতো একজন সত্যানুসন্ধানী ইতিহাসবিদকে হারানোর ক্ষতি অপূরণীয়। উনিশ শতকে বাঙালী রেনেসাঁসের যে সূচনা হয়েছিল, এ বিষয়ে তাঁর গবেষণা ও মূল্যায়ন অত্যন্ত মূল্যবান।’ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। শুধু একজন মানবদরদী ইতিহাসবিদই নন, জাতির সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁকে হারিয়ে অভিভাবকে হারিয়েছি।’ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘উপমহাদেশের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ছিলেন তিনি।’
×