ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এখনও বাংলার পাশে বনি কাপুচিনো

যুদ্ধশিশুদের কান্নায় কেঁদে উঠেছিল মানবিক আত্মা

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪

যুদ্ধশিশুদের কান্নায় কেঁদে উঠেছিল মানবিক আত্মা

মোরসালিন মিজান ॥ শুধু মানবিক বললে কৃপণতা হবে। আশ্চর্য রকমের মানবিক মানুষ বনি কাপুচিনো। এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের দিকে কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মাথা অবনত হয় শ্রদ্ধায়, প্রেমে। সেই ১৯৭২ সালে সুদূর কানাডা থেকে এই মা শুনতে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের কান্না। কত কত সমস্যা-সীমাবদ্ধতা। দুই দেশের মধ্যকার আইনী জটিলতা। সব দু’হাতে ঠেলে পেছনে ফেলেছিলেন তিনি। ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি ও তাঁদের সংগঠন ফ্রেন্ডস ফর দ্য ফ্যামেলিজ ইন কানাডা যুদ্ধশিশুদের কোলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কানাডায়। সেই মানবতাবাদী বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধুটি এখন ঢাকায়। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। হ্যাঁ, পেছনে ফেরা হলো তাঁর। আবারও দেখা হলো একাত্তর। আর উপস্থিত সকলেই দেখলেন তাঁকে। বনি কাপুচিনো অনুষ্ঠান শুরুর একটু আগেই চলে এসেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে অনেকেই জানতেন। তবে সামনাসামনি দেখার সুযোগ পাওয়া গেল এদিন। এখন সোজা হয়ে দাঁড়াবেনÑ সে শক্তি নেই। ধনুকের মতো বাঁকা শরীর। তাতে কী, ভরপুর প্রাণ। উজ্জ্বল রংয়ের পোশাক গায়ে। হাতের প্রায় সবক’টি আঙুলে বিশাল বিশাল পাথর বসানো আংটি। কারুকার্যময়। সুন্দর লিপস্টিক দেয়া ঠোঁট। মিষ্টি হাসেন। চোখে ভারি কাচের চশমা। সেই চশমার কাচ ঘষে নিয়ে দেখেন আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এসব ছবিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নির্যাতিত নারী এবং যুদ্ধশিশু। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তিনি। না, ভুলেননি কিছু। যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে ওড়াল দেয়ার মুহূর্তটা ধরে রেখেছে পুরনো দৈনিক পত্রিকা। সেখান থেকে নিজেকে ঠিকই খুঁজে নিলেন। আঙুল তুলে দেখালেন। তার পর মঞ্চে। ছোট্ট বক্তৃতায় তাঁকে স্বাগত জানালেন জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। বনি কাপুচিনোর পরিচিতি ও সেই সময়টার কথা বললেন আরেক ট্রাস্টি মফিদুল হক। যুদ্ধশিশুদের কানাডায় আশ্রয় করে দেয়ার সংগে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু দলিল এদিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে হস্তান্তর করেন কাপুচিনো। এর পর মূল পর্ব। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন আমন্ত্রিত অতিথি। স্মৃতি থেকে বললেন, ১৯৭২ সালে পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম যুদ্ধশিশুদের কথা। পাকিস্তানী বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত নারীরা নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। দিতে হচ্ছিল। তাঁদের মতো তাঁদের শিশুরাও ছিল রুগ্ন-অসুস্থ। সমাজ বাস্তবতা তাদের অনুকূলে ছিল না। সব দেখে মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খুব দ্রুত কিছু করা জরুরী ছিল। তখন আমরা কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। দূতাবাস খুব সহায়তা করে। রাষ্ট্রদূত আমাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, দ্রুত যান। কিছু করুন, প্লিজ। আশ্বস্ত হয়ে আমরা কানাডার সেই পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করি, যারা যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহী। তার পর জুনে এসে পৌঁছি বাংলাদেশে। জুলাইতে মোট ১৫ যুদ্ধশিশুকে নিয়ে দেশে ফিরি। কাজটি কঠিন ছিল জানিয়ে বনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে ব্যাপার। নানা জটিলতা। আইনী মারপ্যাঁচ। সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়ে জয়ী হতে হয়েছিল। সেদিন মানবতার জয় হয়েছিল। তিনি জানান, কানাডার ১৪টি পরিবার ১৫ শিশুকে দত্তক নিয়েছিল। এক পরিবার নিয়েছিল দু’টি শিশু। কাপুচিনো দম্পতিও একজনকে দত্তক নিয়েছিলেন। নামÑ শিখা। সে কেমন আছে? উপস্থিত সবাই খুব জানতে চাইছিলেন। উত্তরে মমতাময়ী মা জানালেন, এখন সেই যুদ্ধশিশুটি অনেক বড়। নিজেই এখন মা। খুব সুখী। সরকারি একটা চাকরি করেন। অনেকের মধ্যে কেন শিখাকে বেছে নিয়েছিলেন আপনি? এমন প্রশ্নও করা হয় কাপুচিনোকে। দারুণ মজার উত্তর দেন তিনি। বলেন, ও ছিল মোস্ট বিউটিফুল বেবি! কথা শুনে উপস্থিত সবাই হা হা হেসে ওঠেন। বাকি শিশুদের কারা কোথায় কেমন আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরাও বেশ আছে। তবে আমার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। কারণ, যারা তাদের দত্তক নিয়েছেন, যুদ্ধশিশুরা তাদের সন্তান হিসেবে বড় হয়েছে। প্রাইভেসির প্রশ্নে তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করার কোন সুযোগ কেউ রাখেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাপুচিনো জানান, ১৯৭২ সালে তিনি ছিলেন ৩৫ থেকে ৪০ বছরের। এখন বয়স ৮০। অনেকে এদিন জেনে অবাক হন, বনি কাপুচিনো নিয়মিত বাংলাদেশে আসেন। তবে এতো নিভৃতে যে, কেউ তা জানেন না। কেন? কী উদ্দেশে আসা? জানতে চাইলে আবারও অবাক হওয়ার পালা। তিনি জানান, এখনও বাংলাদেশকে ভালবাসেন। এক যুগ আগে শিশু স্বর্গ নামে চট্টগ্রামে চালু করেছেন অনাথ আশ্রম। ভারত নেপালসহ আরও কয়েকটি দেশেও ছুটে যাচ্ছেন। কাজ করছেন। এভাবে জীবনের পুরোটাই অসহায় দুস্থদের জন্য ব্যয় করে চলেছেন। এমন সোনার মানুষ সত্যি কম হয়।
×