ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকার বঞ্চিত রাজস্ব থেকে

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

সরকার বঞ্চিত রাজস্ব থেকে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশের বিভিন্ন গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস উৎপাদনকালে প্রাপ্ত কনডেনসেট (তলানি) অবৈধভাবে ও চোরাপথে ভেজাল হয়ে পেট্রোল হিসেবে বাজারজাত হচ্ছে। এতে করে একদিকে সরকার যেমন মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি অপরদিকে ভোক্তারাও ঠকছে, যানবাহনসহ বিভিন্ন শ্রেণীর যন্ত্রাংশের মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনছে। সরকারি পর্যায়ে যথাযথ মনিটরিং, মোবাইল টিমের কার্যকর কোন ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি এখন লাগামহীন। জ্বালানী সেক্টরে সরকারি পর্যায়ে একক আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে গত চার বছর ধরে পেট্রোলের কোন আমদানি নেই। অথচ, পেট্রোলির চাহিদা রয়েছে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠে, চাহিদার এ পেট্রোল কোথা থেকে আসছে এবং তা কিভাবে বাজারজাত হচ্ছে। সূত্র মতে, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে যে সমস্ত জ্বালানী পরিশোধনের রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা হয়েছে এদের অনেকেই অবৈধ ও চোরা পথে গ্যাসফিল্ড থেকে আহরিত কনডেনসেটের সরবরাহ নিয়ে তা সরাসরি পেট্রোল পাম্প ও কনডেনসেট পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে করে লিটার প্রতি তাদের লাভ যেমন বাড়ছে, তেমনি সরকারি খাতে কোন রাজস্বও প্রদান করতে হচ্ছে না। বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সরকার এ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে জ্বালানী পরিশোধনের ২৫টি রিফাইনারির অনুমোদন (এনওসি) দিয়েছে। এরমধ্যে ১৩টি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, ১০টি উৎপাদনে গেছে। ৩টি উৎপাদনে যাবার পথে। অবশিষ্ট ১২টি প্রতিষ্ঠার পাইপ লাইনে রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কোন ধরনের গবেষণা বা মাঠ পর্যায়ের রিপোর্ট ছাড়াই সরকারি পর্যায়ে একের পর এক বেসরকারি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার অনুমোদন প্রদান অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে, এসব বেসরকারি রিফাইনারির কার্যক্রম এবং উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বিপিসি, খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিইআরসি ও বিএসটিআই-এর কারো পক্ষে কোন ধরনের মনিটরিং ও মোবাইল টিমের কার্যকারিতা নেই। ফলে কনডেনসেট নিয়ে ভেজালের তেজারতি লাগামহীন পর্যায়ে পৌছেছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের চারটি গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস আহরণকালে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন কনডেনসেট পাওয়া যাচ্ছে। সিলেট গ্যাসফিল্ড লিঃ (এসজিএফএল), বিজিএফসিএল (বাখরাবাদ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিঃ), বাপেক্স, আইওসি (বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড) থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন কনডেনসেট উৎপাদিত হচ্ছে। এরমধ্যে ১ লাখ টনেরও বেশি কনডেনসেট গ্যাসফিল্ডেই ফ্র্যাকসেনেশন প্ল্যান্টে পরিশোধিত হচ্ছে। অবশিষ্ট কনডেনসেট বিভিন্ন বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলোকে পরিশোধনের মাধ্যমে পুনরায় বিপিসিকে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এসব বাধ্যবাধকতা অধিকাংশ বেসরকারি রিফাইনারি না মেনে তা অবৈধ ও চোরাপথে বাজারজাত করছে অধিক মুনাফা আয়ের লক্ষ্যে। সূত্র জানায়, বেসরকারি রিফাইনারিগুলোকে বর্তমানে কনডেনসেট রিফাইন করে পেট্রোল, কেএসও কেরোসিন, এমটিটি (মিনারেল টারপেনটাইন) উৎপাদন করছে। এছাড়া একটি কোম্পানি সরকার নিয়ন্ত্রিত ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত নাফতা সরবরাহ নিয়ে তা থেকে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছে। বিপিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে পেট্রোলের চাহিদা প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টন হলেও তা দেশীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পেট্রোলের কারণে আমদানি হচ্ছে না। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আমদানিকৃত ক্রুড অয়ের থেকে বছরে প্রায় ৬০ হাজার টন পেট্রোল উৎপাদন হয়ে তা বিপিসির মাধ্যমে তিন তেল কোম্পানিকে সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদার অবশিষ্ট পেট্রোল গ্যাসফিল্ডের কনডেনসেট ভেজাল হয়ে চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভোক্তারা ব্যাপকভাবে যেমন ঠকছে, তেমনি যানবাহন ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সূত্র জানায়, পেট্রোলিয়াম এ্যাক্ট অনুযায়ী বেসরকারি পর্যায়ের রিফাইনারিগুলো গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে কি পরিমাণ কনডেনসেট পাবে এবং উৎপাদনের পর তা ইস্টার্ণ রিফাইনারিকে সরবরাহ দেওয়ার বাধ্যবাধতা রয়েছে। এসব নিয়ম কানুন মূলত কাগজে কলমে পরিণত হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে বিপিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন বিপিসির নিজ্স্ব একটি ল্যাবরেটরী রয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি অভ্যন্তরে। দেশজুড়ে তিন তেল কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত পেট্রোল পাম্পগুলোতে মোবাইল টিম বা মনিটরিং টিমের কোন তৎপরতা চলছে না দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়া লজিস্টিক সুবিধাও একেবারে অপ্রতুল। এ সুযোগে পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভেজাল তেলের ঘটনা ঘটছে বলে তাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে।
×