ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এরা পাকিস্তানের পক্ষে সশস্ত্র লড়াই করে প্রথম থেকে বাঙালীদের বিরাগভাজন ছিল ;###; সেই বিহারীদের ৬৫ ভাগ এখন বাংলাদেশের ভোটার বলে দাবি তাদের ;###; সরকারও তাদের পুনর্বাসনের কথা ভাবছে

জেনেভা ক্যাম্পে উর্দুভাষী পাকিস্তানীরা ॥ এসব ‘বিহারীরা’

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

জেনেভা ক্যাম্পে উর্দুভাষী পাকিস্তানীরা ॥ এসব ‘বিহারীরা’

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আটকেপড়া পাকিস্তানীদের সে দেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেমে গেছে। ইতোমধ্যেই উর্দুভাষী এসব লোকের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ ভোটার হওয়ায় জটিলতা আরও বেড়েছে। বেশিরভাগ বিহারীই এখন পাকিস্তানে যেতে নারাজ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় বিহারী সমস্যা দিন দিন জটিল আর প্রকট হচ্ছে। বাড়তি জনসংখ্যার কারণে ঢাকার ক্যাম্পগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বহুতল পাকা বাড়ি উঠছে। যে কোন সময় এসব বাড়ি ধসে পড়লে শত শত মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার উর্দুভাষী অবাঙালীদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করছে। ঢাকার বিহারীদের কেরানীগঞ্জে এবং অন্যান্য জেলার বিহারীদের ওইসব জেলার কোন সুবিধাজনক জায়গায় পুনর্বাসনের কথা ভাবছে। বহুতল ভবনে ছোট ছোট ফ্ল্যাট তৈরি করে তা বিহারীদের দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বিহারীদের পুনর্বাসনের জন্য অধিগ্রহণ ও ক্রয়কৃত জমির পরিমাণ, কী পরিমাণ জমি দখলমুক্ত রয়েছে, বিহারীরা কী পরিমাণ জমির ওপর বসবাস করছেন ও পুনর্বাসনের জন্য কী পরিমাণ জমি লাগবে তার বিস্তর হিসাব চলছে। বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে উদ্বৃত্ত জায়গা শিল্প স্থাপনের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে। আটকে পড়া পাকিস্তানী হওয়ার প্রেক্ষাপট ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের কারণে উপমহাদেশের মুসলমান ও হিন্দুরা ভারত-পাকিস্তানে আলাদা হয়ে যায়। ওই সময় ভারতের দিল্লী, কর্ণাটক, কেরালা, রাজস্থান, তামিলনাড়ুসহ বিভিন্ন রাজ্যের অনেক মুসলমান মুসলিম দেশে বাস করতে আগ্রহ দেখায়। আগ্রহীদের তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কৌশলে বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থাকার ব্যবস্থা করে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে উর্দুভাষী বিহারীরা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালেও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তারা পাকিস্তানের পক্ষে সশস্ত্র লড়াই করে। তারা বাংলাদেশে নয় পাকিস্তানে বসবাসের পক্ষে অপশন দেয়। নিজেদের পাকিস্তানী দাবি করে। মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীনের পর উর্দুভাষী পাকিস্তানীদের জাতিসংঘের মাধ্যমে ‘জেনেভা ক্যাম্পে’ আপাতত বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়। বলা হয় তারা পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানে চলে যাবে। পরবর্তী সময়ে পাক সরকার উর্দুভাষীদের সে দেশে নাগরিক করতে না চাইলে তৈরি হয় জটিলতা। যদিও বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালীদের দাবি, সবাই পাকিস্তান সর্মথন করেননি। আটকে পড়া পাকিস্তানীদের সংগঠন এসপিজিআরসির সৃষ্টি ॥ স্বাধীনতার বিরোধিতা করায় স্বাধীন দেশের নাগরিকরা স্বাভাবিক কারণেই অবাঙালী বিহারীদের শত্রু হিসেবে দেখা শুরু করেন। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে স্বাধীনতার পর পরই আন্তর্জাতিক রেডক্রস বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় উর্দুভাষী বিহারীদের বসবাসের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করে। সে সময় অধিকাংশ বিহারীরাই পাকিস্তানে চলে যেতে আগ্রহ দেখায়। বিহারীদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর এসপিজিআরসি (স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি) নামে একটি সংগঠন করে উর্দুভাষী অবাঙালীরা। এসপিজিআরসির হিসাবে বিহারী ক্যাম্প ও জনসংখ্যা ॥ এসপিজিআরসি ১৯৯২ সালে মক্কাভিত্তিক রাবেতা আল ইসলাম নামে একটি এনজিওর সঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী বিহারীদের ওপর যৌথ জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ মোতাবেক দেশের ১৭ জেলায় ৭০ বিহারী ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছয়টি ও মিরপুরে ২৫। বাকি ৩৯ ক্যাম্পের মধ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর ও নীলফামারীতে একটি করে, নারায়ণগঞ্জে ৩, যশোরে ৯, রংপুরে ২, রাজশাহীতে ২, চট্টগ্রামে ৫, ঈশ্বরদীতে ৪ ও খুলনায় রয়েছে পাঁচটি। জরিপ অনুযায়ী ওই সময় ক্যাম্পের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ সাড়ে ৩৭ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। মোহাজির ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের হিসাব ॥ এসপিজিআরসির মতো মোহাজির ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন নামের সংগঠনটিও আটকে পড়া পাকিস্তানী বা উর্দুভাষী মোহাজিরদের নিয়ে কাজ করে। মোহাজির ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত বৈধ সংগঠন। সংগঠনটির সভাপতি ইকবাল হোসেন ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অসি আহমেদ অসির দাবি, ৭ বিভাগে কাগজে-কলমে ৩৮ জেলায় ৭০ নয়, ১১৬ বিহারী ক্যাম্প রয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছেÑ ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, পাবনা, রংপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, খুলনা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নড়াইল, বরিশাল, বরগুনা ও সিলেট। পুনর্বাসনে অধিগ্রহণকৃত জমি ॥ মোহাজির ওয়েল ফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন সূত্রে সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী দেশের ৩৮ জেলায় মোহাজিরদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারীভাবে ৩৩ হাজার ৯৮৬ দশমিক ১৮৩ একর জমি অধিগ্রহণ ও ক্রয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৭টি জেলায় ২ হাজার ১৫৭ দশমিক ৯৬৬ একর, চট্টগ্রাম বিভাগের ৭ জেলায় ২৫০ দশমিক ১৬৮ একর, রাজশাহী বিভাগের ৫ জেলায় ৬০১ দশমিক ২১৫ একর, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ১৭ হাজার ১৪৬ দশমিক ৬১০ একর, খুলনা বিভাগের ৮ জেলায় ৫ হাজার ৬৭১ দশমিক ২১৩ একর, বরিশাল বিভাগের ২ জেলায় ৮ দশমিক ৫০৪ একর ও সিলেট বিভাগের ১ জেলায় ৬ হাজার ১৭৯ দশমিক ৮২০ একর জমি সরকারীভাবে অধিগ্রহণ ও ক্রয়কৃত অবস্থায় আছে। বিহারীদের জন্য পাকিস্তানে থাকার ব্যবস্থা ॥ ২০০৫ সাল থেকে এসপিজিআরসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন বিহারী জব্বার খান। সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের অফিসে বসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, রাবেতা আল ইসলামের জরিপের পর অবাঙালী পরিবারগুলোকে পাকিস্তান যাওয়ার ব্যবস্থা করতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। এ সংক্রান্ত ৪টি চুক্তিও হয়। চুক্তি মোতাবেক ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট প্রথম ধাপে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার অবাঙালী পরিবারের পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দুই দেশের তৎপরতায় ওই বছরের ১০ জানুয়ারি প্রথম দফায় ৫৬ পরিবারের ৩২৫ সদস্য পাকিস্তানে যেতে সক্ষম হয়। তাদের রাখা হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়া চুন্নু জেলায় অবস্থিত পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পাকিস্তানের এই জেলাটিতে বাংলাদেশে থাকা অবাঙালী উর্দুভাষীদের পুনর্বাসনের জন্য ৩শ’ একর জমি লিজ নিয়ে রেখেছে পাকিস্তান সরকার। আর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের হাবিব ব্যাংকে ১১১ মিলিয়ন পাকিস্তানী রুপী আর পাঞ্জাবের মিয়া চুন্নু জেলায় ২ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা পাকিস্তানে যাবেন তাদের পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে এসব প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রথম কিস্তি যাওয়ার পরই বিষয়টি ঝুলে যায়। অদ্যাবধি আর কোন অবাঙালী পরিবার বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়নি। এখন ক্যাম্পের অধিকাংশই এদেশের ভোটার হয়েছেন। তাই তারা পাকিস্তানে যেতে চান না। ক্যাম্পবাসীদের দাবি ॥ রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর জয়েন্ট কোয়ার্টার ক্যাম্পের বাসিন্দা তোরাব হোসেন (৬৫) জনকণ্ঠকে বলেন, আমার তিন ছেলে। আমি এদেশের নাগরিকত্ব পাইনি। কিন্তু আমার ছেলেরা পেয়েছে। আমার স্ত্রী নেই। আমি তিন সন্তানকে নিয়ে অন্যকোন দেশে যেতে চাই না। মিষ্টির প্যাকেট তৈরি করছেন তোরাব হোসেনের বড় ছেলে দেলোয়ার হোসেন পাপ্পু (৩৫)। বললেন, আমি এদেশের ভোটার। আমার এক স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। আমরা জন্মসূত্রে এদেশের নাগরিক। এদেশেই থাকতে চাই। তারপরও সরকার যদি আমাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা যেতে বাধ্য। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। আমরা ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছি। গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। নোংরা ক্যাম্পে বসবাসের উপায় নেই। ক্যাম্পে নানা অসামাজিক কর্মকা-ের পাশাপাশি মাদক একটি বড় সমস্যা। তিনি বলছেন, ক্যাম্পে জনসংখ্যা বাড়ছে। বাড়তি জনসংখ্যার বসবাসের জন্য বাড়তি কোন জায়গা নেই। স্বাভাবিক কারণেই ক্যাম্পের বাসিন্দারা ছোট ছোট ঘরের ওপর বহুতল ঘর তৈরি করছে। এসব অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত ঘর যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। তখন শত শত মানুষের মৃত্যু হবে। যত্রতত্র বিদ্যুতের তার ঝুলে আছে। যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, না ঘটাই অস্বাভাবিক। একই ক্যাম্পের নরসুন্দর (নাপিত) রনি (২২) বলছেন, আমি এদেশের ভোটার। আমার জন্ম এখানে। আমি কোথায় যাব? তারপরও বাপ-দাদারা যদি চলে যায় বা সরকার যদি পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় আমরা যেতে বাধ্য। তবে আমরা এদেশেই থাকতে চাই। সরকার যেন আমাদের জন্য ন্যূনতম থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ক্যাম্পের জীবন কতটা কষ্টের না দেখলে বা বসবাস না করলে বলে বুঝানো কঠিন। ক্যাম্পের পানি, বিদ্যুত নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের বাড়তি টাকা আদায়, মাদক সমস্যা, যেকোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাসহ বহু ধরনের বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়। এমন দাবি ক্যাম্পের প্রায় সবারই। অধিকাংশ বিহারীর অভিযোগ, তাদেরকে পুঁজি করে বহু এনজিও ব্যবসা করছে। বিদেশ থেকে তাদের দেখিয়ে বহু আর্থিক অনুদান আনছে। অনুদান আনা এসব টাকা খেয়ে ফেলছে এনজিওসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী। এজন্য তাদের জীবনমানের কোন উন্নতি হচ্ছে না। মেরি স্টোপস, রাড্ডা, বার্নার, ওয়ার্ল্ড ভিশন, ব্র্যাক ও সৌরভসহ বহু এনজিও বিহারী ক্যাম্পগুলোতে কাজ করে। যদিও এসব এনজিও এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে ক্যাম্পবাসীদের অভিযোগ মনগড়া বলে দাবি করা হয়েছে। এক শ্রেণীর অসাধু বিহারী নেতৃবৃন্দের কথায় ক্যাম্পবাসীদের অনেকেই এ ধরনের অভিযোগ করে থাকেন। যদিও সরেজমিনে বিহারীদের জীবনমানের উন্নয়নের কোন চিত্র চোখে পড়েনি। ক্যাম্পগুলোর বর্তমান অবস্থা ॥ সরেজমিনে মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের একাধিক ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন বাসিন্দারা। যাঁরা আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান তাঁরা ক্যাম্প ছেড়ে আশপাশের এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। অনেকেই আবার বাঙালী মেয়ে বিয়ে করে ঘর সংসার করছেন। তাদের সন্তানাদি এদেশের স্কুল-কলেজে পড়াশুনাও করছে। ভাল ভাল চাকরিও করছেন। ক্যাম্প ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের অপতৎপরতা। বিশেষ করে এনজিও, বিভিন্ন সেবা সংগঠন, দাতব্য সংস্থা, মাদক ব্যবসায়ী, পেশাদার অপরাধী, জমির দালাল, ভূমিদস্যুসহ নানা ধরনের লোকের আনাগোনা রয়েছে ক্যাম্পগুলোতে। ক্যাম্পগুলোতে ভয়াবহ আকারে মাদকের ব্যবহার হচ্ছে। এসব মাদক ছড়িয়ে পড়ছে ক্যাম্পের আশপাশের এলাকাগুলোতেও। সস্তায় অতি সহজেই মাদক পাওয়া যাওয়ার কারণে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যত্রতত্র মাদক সেবন করার দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রসঙ্গত, বিহারী ক্যাম্পগুলোতে জাল টাকা ও মাদক ব্যবসা ছাড়াও বোমা তৈরি হয়ে থাকে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে শাহীন ও নাদিম নামে দুজন আহত হয়। আহত দুজন ছাড়াও আহত নাদিমের ভাই বশিরকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের তথ্যমতে, বোমা তৈরি করে মজুদ রাখা ১শ’ বোমা উদ্ধার হয়। পরদিন ২১ ডিসেম্বর র‌্যাব-২ এর একটি দল জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে আরেকটি বোমা তৈরির কারখানা থেকে ৩২ তাজা বোমা ও বোমা তৈরির সময় ব্যবহৃত মুখোশসহ বেশ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছিল, জেনেভা ক্যাম্পের বোমা তৈরির কারখানায় বহুদিন ধরে বোমা তৈরি হচ্ছে। তৈরিকৃত বোমাগুলো সরকার বিরোধী নানা নাশকতামূলক কর্মকা- চালাতে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ব্যবহার করেছে। বহু অভিযানেও ক্যাম্পগুলো থেকে মাদক নির্মূল করা যায়নি। মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে বেরিয়েই আবার মাদক ব্যবসা শুরু করে। এজন্য সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের করার পর তাৎক্ষণিক সাজা চালু করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ নবেম্বর মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্প থেকে ইয়াবাসহ হাতেনাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতে ধরা পড়ে ইয়াবা সুন্দরী পাপিয়াকে ২ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ক্যাম্পগুলোতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আবাসনের জন্য কোন প্রকার নিয়ম নীতি ছাড়াই একের এর এক ঘর উঠছে। এসব ঘর তোলা হচ্ছে আধাপাকা ঘরের ওপর। কোন কোন ক্যাম্পে চারতলা পর্যন্ত ভবন উঠেছে। এসব বাড়ি নির্মাণে প্রয়োজনীয় মালামাল ব্যবহার করা হয়নি। কোনমতে ইট, বালু আর সিমেন্ট দিয়েই তৈরি হচ্ছে ৪/৫ তলা বাড়ি। ফলে যেকোন সময় এসব বাড়ি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধসে পড়লে তা নিচে থাকা বাড়িঘরের উপর পড়বে। এতে শত শত মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। বিহারী নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ॥ বিহারীদের সংগঠন এসপিজিআরসির সভাপতি জব্বার খান জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যাম্পগুলোতে মাদক ব্যবসা নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ মাদক সেবন করতে পারে। সেটি তাদের নজরে আসেনি। ক্যাম্পের বাসিন্দারা আর পাকিস্তানে যেতে আগ্রহী নয়। ক্যাম্পের অনেকেই এখন ভোটার। তারা বাংলাদেশে থাকতেই আগ্রহী। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সারাদেশে থাকা ৭০ ক্যাম্প কি পরিমাণ জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে তাদের কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই। তিনি ক্যাম্পবাসীর জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, দিন যত যাচ্ছে জনসংখ্যার চাপের কারণে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পগুলোতে বহুতল বাড়ি উঠছে। এসব বাড়ি গড়ে উঠছে কোন প্রকার পরিকল্পনা ছাড়াই। ফলে যেকোন সময় বাড়ি ধসে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু হওয়াও বিচিত্র নয়। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বিহারীদের পক্ষে এসপিজিআরসি সংগঠনের হয়ে তাঁরা স্থানীয় সরকার মন্ত্র্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি শুনে প্রধানমন্ত্রী তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার কথা বলেছিলেন। এরপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিহারীদের পুনর্বাসনের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তাব ওঠে। ওই সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বিহারীদের পুনর্বাসন করতে কি পরিমাণ জমি লাগবে, কয়টি বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হবে, আবাসিক এলাকায় কি কি সুবিধা থাকবে সে সবের একটি ফিরিস্তিও তৈরি করা হয়। পুরো বিষয়টি এসপিজিআরসি নেতৃবৃন্দকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে নিয়ে সরাসরি বিশাল স্ক্রিনে দেখানো হয়। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর কথা জানানো হয় তাদের। অদ্যাবধি বিষয়টির আর কোন অগ্রগতির কথা জানা যায়নি। দ্বিতীয় মেয়াদে বর্তমান সরকার ক্ষমতা লাভের পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বলে তিনি নানা সূত্রে জানা গেছে। এদিকে বিহারীদের আরেকটি সংগঠন মোহাজির ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল হোসেন ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অসি আহমেদ অসির দাবি, সারাদেশে ৭০টি নয়, ১১৬টি বিহারী ক্যাম্প রয়েছে। তারা আটকে পড়া পাকিস্তানী নন। ১৯৯২ সালে ৫৬ পরিবারের ৩২৫ সদস্য পাকিস্তানে যাওয়ার পর পুরো প্রক্রিয়া আটকে যায়। এরপর থেকেই তারা আটকে পড়া পাকিস্তানী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। আসলে তারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা উর্দুভাষী অবাঙালী। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অসি আহমেদ অসির দাবি, ক্যাম্পের শতকরা ৬৫ ভাগ বাসিন্দাই ভোটার। ভোটারসহ অধিকাংশ বিহারীই পাকিস্তান যেতে নারাজ। বিশেষ করে পাকিস্তানে দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে প্রায় সবাই পাকিস্তানে বসবাসের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকেই আবার জন্মসূত্রে এদেশের নাগরিক। তিনি সরকারের কাছে পুনর্বাসনের দাবি জানান। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে রোজগারের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখার অনুরোধ করেন তিনি। তাদের যেন এমন জায়গায় পুনর্বাসন করা হয়, যেখান থেকে তারা অনায়াসে জীবন চালানোর মতো রোজগার করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ঢাকার আশপাশে হলে ভাল হয়। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখার এক চিঠিতে বলা হয়, ঢাকায় বসবাসরত বিহারীদের পুনর্বাসনের জন্য ৫০ একর জমি যথেষ্ট নয়। তাই ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে আতিশুর এলাকার কালি নদী মৌজায় ৭৪ দশমিক ৭২ একর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। তার দাবি, যেখানেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক না কেন সেখানে যেন রোজগারের পথ থাকে। অন্যথায় মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিহারীদের পুনর্বাসনে সরকারের পরিকল্পনা ॥ উর্দুভাষী অবাঙালীদের বসবাসের ক্যাম্পগুলোর সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, কাম্পগুলোতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্যাম্পের আশপাশের জায়গায় যত্রতত্রভাবে ঘর তুলে বসবাস করছে ক্যাম্পবাসীরা। বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পানি ও বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে গেছে। ক্যাম্পগুলোতে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুতের জন্য সরকারকে কোন প্রকার বিল পরিশোধ করতে হয় না। এজন্য ক্যাম্পের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি পানি ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দিয়ে থাকেন। এতে প্রতিমাসে শুধু ঢাকার ক্যাম্পগুলো থেকেই অন্তত ১০ কোটি টাকার বিদ্যুত অপচয় হচ্ছে। চলতি বছরের জুনে মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, অনেক বিহারীই ভোটার। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান কত তা জানাতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বলা হয়। ভোটারদের আলাদা তালিকা করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়। কারণ যেসব বিহারী ভোটার তারা বিদ্যুত ব্যবহার করলে সরকারকে বিদ্যুতের বিল দিতে হবে বলেও চিঠিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বিহারী ক্যাম্পগুলো কি পরিমাণ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার প্রকৃত হিসেব জানার চেষ্টা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি জেলা এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে। তবে ঢাকা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, মেহেরপুর ও সিলেট জেলার তরফ থেকে বিহারীদের বসবাসের ক্যাম্পের জায়গা সংক্রান্ত কোন তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় দ্রুত এসব জেলা প্রশাসককে বিহারী ক্যাম্পগুলো কি পরিমাণ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা জানাতে তাগিদ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বিহারীদের পুনর্বাসনের জন্য স্বল্প জায়গার ওপর বহুতল নির্মাণের একটি প্রস্তাবও দেয়া হয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে। এলকন বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানির তরফ থেকে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের একটি নকশাও দেয়া হয় ওই প্রস্তাবের সঙ্গে। প্রস্তাবপত্রে আবাসিক ভবনের পাশাপাশি হাসপাতাল, স্কুল ও ক্লিনিকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাবও রয়েছে। এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম) জনকণ্ঠকে জানান, এদেশে বসবাসরত বিহারীদের তারা ভালভাবে দেখভাল করছেন। তাদের যেকোন ধরনের সুবিধা অসুবিধা তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকেন। বিহারীদের নানা সুবিধা অসুবিধার বিষয়ে তারা সবসময় খোঁজখবর রাখছেন। তাদের পুনর্বাসনের বিষয়েও সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহ্রিয়ার আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। তবে পাকিস্তানের তরফ থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তারপরও আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বিহারীদের অনেকেই ভোটার। ভোটাররা পাকিস্তানে যেতে নারাজ। আর যারা এদেশে জন্ম নিয়েছে তারা কোনক্রমেই পাকিস্তানে যাওয়ার পক্ষে নয়। ফলে সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারপরও সমস্যা সমাধানের স্থায়ী পথ খোঁজা হচ্ছে। সম্মিলিত উদ্যোগ ব্যতীত এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা কঠিন। বিহারীদের নিয়ে সৃষ্ট জটিল সমস্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
×