ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের তাগিদ

অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত করতে পারে বিশাল সমুদ্র সম্পদ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত করতে পারে বিশাল সমুদ্র সম্পদ

ফিরোজ মান্না, চট্টগ্রামের বানৌজা ঈসা খাঁ ঘাঁটি থেকে ফিরে ॥ সম্ভাবনাময় সমুদ্র সম্পদ রক্ষা ও আহরণের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গড়ে তোলা জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রায় দেশের সমান আরেকটি দেশ ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে বড় ভূমিকা পালন করবে। এই দেশটির পানির নিচে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তার জন্য সঠিক জরিপ, গবেষণা, অনুসন্ধান, উত্তোলন পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সমুদ্র সম্পদ রক্ষার জন্য নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার জনবল বাড়াতে হবে। আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তুলতে না পারলে বিশাল সমুদ্রসীমা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সম্পদের বিরাট ভা-ারের সুরক্ষার প্রয়োজনীতা দেশের মানুষের কথা ভেবেই করতে হবে। কারণ সাগরের নিচে এত সম্পদ রয়েছে-যা থেকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির ফলে বাংলাদেশ বিশাল সামুদ্রিক অঞ্চলের সম্পদের ওপর একচ্ছত্র অধিকার পেয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম হয়েছে। বঙ্গোপসাগর অববাহিকায় বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব মানুষ তাদের খাদ্য, জীবিকা ও নিরাপত্তার জন্য উপকূলীয় ও সামুদ্রিক সম্পদের (১৯ পৃষ্ঠা ৬ কঃ দেখুন) অর্থনৈতিক ভিত (২০-এর পৃষ্ঠার পর) ওপর নির্ভরশীল। বঙ্গোপসাগর ইকোসিস্টেমকে যেসব বিষয় প্রভাবিত করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-আন্তঃসীমানা বিষয়, মৎস্যসম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলের অবনতি, দূষণ ও পানির মান। বঙ্গোপসাগরের মাছ ধরার জন্য যে জায়গায় ৭৭টি ট্রলার থাকার কথা সেখানে ২৬৬টি ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সমুদ্র উপকূল থেকে ৪০ মিটার গভীর পানি যেখানে সেখান থেকেই মাছ আহরণ করতে হবে। কিন্তু ট্রলারগুলো সেই নিয়ম মানছে না। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের ২০১২ সালের ১৪ মার্চ এবং স্থায়ী সালিশী আদালতে (পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন- পিসিএ) বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের এ বছরের ৭ জুলাই রায়ের ফলে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে ১২ নটিক্যাল মাইলের রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র, ২শ’ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সকল প্রাণিজ ও খনিজসম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্রের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। সমুদ্র সম্পদের নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম বাধা অতিক্রম করতে হবে। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও তার সুরক্ষা জরুরী। সমুদ্র গবেষকরা বলেন, এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমুদ্র অঞ্চল ও এর পরিবেশ রক্ষা এবং সম্পদের টেকসই আহরণের জন্য একটি বহুমুখী পরিকল্পনা হাতে নেয়া। সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও উন্নয়নে সরকারী নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশন গঠন করা। সমুদ্রে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে জরুরীভিত্তিতে উপযুক্ত ও ব্যাপকভিত্তিক সমুদ্রনীতি এবং কর্মকৌশল প্রণয়ন করা। ২০৫০ সালকে টার্গেট করে একটি সমুদ্র রূপকল্প তৈরি করা। জরুরীভিত্তিতে সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের সঠিক জরিপ করা। সমুদ্রের তলদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের মাধ্যমে দেশের দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং মৎস্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষায় নৌবাহিনীকে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে দেশী-বিদেশী জাহাজে দস্যুতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করা। এদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আয়োজিত দুইদিনের সেমিনারেও সমুদ্র সম্পদের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সেমিনারে বলা হয়েছে, সমুদ্রসীমা বেড়ে যাওয়ার পর দেশের অর্থনীতির চিত্রই পাল্টে যাচ্ছে। তবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে যেতে প্রয়োজন অর্জিত সীমায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। দেশের সমুদ্রসীমার ৪৫ হাজার কিলোমিটার এলাকা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এই বিশাল এলাকা ব্যবহার করতে হলে নৌবাহিনীর শক্তি বাড়াতে হবে। ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হলে নৌবাহিনীর কর্মপরিধি আরও বাড়াতে হবে। জনবল ও বাজেট সুবিধা বাড়াতে হবে। প্রায়ই পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের মাছ ধরা ট্রলার ও নৌকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে। এটা যে কোন মূল্যে বন্ধ করতে হবে। চট্টগ্রামের নৌঘাঁটি বানৌজা ঈসা খাঁর কমান্ড মেসে ‘সমুদ্র জয়ের নিরাপত্তা ও জাতীয় অর্থনীতিতে সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, ব্লু ইকোনমির নতুন সম্ভাবনাকে সুচারুভাবে ব্যবহার করতে হলে সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। সমুদ্র সম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ঘিরে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন তৈরি করার এখন উপযুক্ত সময়। সমুদ্র জয়ের মধ্য দিয়ে দেশের ইকো-ট্যুরিজমে আসবে বিপ্লব। সমুদ্র জয় আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। বাংলাদেশকে দশটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। ব্লু ইকোনমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে এখন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দ্রুত উদ্যোগ নেয়া জরুরী। ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হলে নৌবাহিনীর কর্মপরিধি আরও বাড়াতে হবে। জনবল ও বাজেট সুবিধা বাড়াতে হবে। প্রায়ই পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের মাছ ধরা ট্রলার ও নৌকা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে পড়ে। এটা যে কোন মূল্যে বন্ধ করতে হবে। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মাছ ধরা ট্রলারগুলো বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এসে মাছ ধরে চলে যায়। এগুলো বন্ধ করতে নৌবাহিনীকে আধুনিক করতে হবে। যদিও বর্তমান সরকার নৌবাহিনীকে ত্রি-মাত্রিক বাহিনী করার জন্য নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। নৌবাহিনীতে বর্তমানে ৭৩টি ছোট-বড় জাহাজ রয়েছে। দুটি হেলিকপ্টার রয়েছে। কিছুদিন পরেই নৌবাহিনীতে যোগ হচ্ছে সাবমেরিন। এরপরও বিশাল সমুদ্রসীমায় টহল দেয়ার কাজটি এখনও কঠিন। কারণ বঙ্গোপসাগর এমন একটি সাগর যেখানে বছরের ৬ থেকে ৭ মাস অস্বাভাবিক অবস্থা থাকে। এই সময়টায় মাছ ধরার ট্রলার সাগরে যেতে পারে না। গেলেও তাদের অনেক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। একইভাবে নৌবাহিনীর ছোট জাহাজগুলোও সাগরে যেতে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে। নৌবাহিনীর বর্তমান শক্তিকে দ্বিগুণ শক্তিতে পরিণত করে বিশাল সমুদ্রসীমা পাহারা ও সম্পদ রক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে। সমুদ্রসীমার মধ্যে ৪৫ হাজার কিলোমিটার পানি অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এই পানি ব্যবহারের আওতায় আনতে পারলে সমুদ্র সম্পদ আহরণে আরও ব্যাপকতা বাড়বে।
×