নিখিল মানখিন ॥ আট বছরের গারো মেয়ে মাটি বনোয়ারী। তার সারা শরীরে আদিবাসী গারো সংস্কৃতির ছাপ। ছোট আকারের নকমান্দা ও টি-শার্ট পরে সে রাজধানীর বটমূলী অর্ফানেজ টেকনিক্যাল স্কুল প্রাঙ্গণের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একই পোশাক পরেছে তার ছোটবোন কৃষ্টি বনোয়ারী। মঞ্চে চলছে গারোদের নাচ ও গান। মনের অজান্তেই নিজেদের সংস্কৃতির অতি পরিচিত গানের তালে তালে নাচতে থাকে দুই বোন। বছরে একদিন এমন পোশাক পরার এবং সকলের সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ পায় তারা। শুধু এই ছোট দুই বোন নয়, শুক্রবার ঢাকায় বসবাসরত সব বয়সের কয়েক হাজার গারো তাদের আদিবাসী সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব ‘ওয়ানগালা’ পালন করে দিনব্যাপী পুজো-অর্চনা, আলোচনা, নাচ-গানে এ উৎসব পালন করেছে রাজধানীতে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়।
আয়োজকরা জানান, ওয়ানগালা ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। আদিবাসী গারোদের বিশ্বাস, শস্য দেবতা ‘মিশি সালজং’ পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারাবছর পরিমাণ মতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভাল শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় ‘মিশি সালজং’কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করে গারোরা। শস্য দেবতাকে উৎসর্গ না করে তারা কোন খাদ্য ভোগ করে না। ‘ওয়ানগালা’ আদিবাসী মান্দি বা গারোদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দেড় এক যুগ ধরে প্রতিবছর নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় বসবাসরত গারোরা এ উৎসব পালন করছে। যুগ যুগ ধরে গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এভাবেই ফসল উৎসর্গ করে আসছে। খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোদের ঐতিহ্যবাহী এ সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে পালন করা হয়। অর্থাৎ এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা ‘মিশি সালজং’কে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ‘ওয়ানগালা’ পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়।
শুক্রবার ঢাকায় ওয়ানগালা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় গারোদের আলোচনা সভা। নকমা সুকলেস নকরেকের সভাপতিত্বে আলোচনা অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ খ্রিস্টান এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের বিশপ পনেন পৌল কুবি, সাবেক তথ্য কমিশনার ড. সাদেকা হালিম, বাংলাদেশ খ্রিস্টান এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্মল রোজারিও, কারিতাসের পরিচালক (ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউশন) থিউফিল নকরেক। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑ ধোবাউড়া থানা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক ডেভিড রানা চিসিম ও নির্বাহী সদস্য সৌরিন আরেং সেং।
শুক্রবার সকালে দেবতা পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় ‘ওয়ানগালা উৎসব’। ‘আমুয়া’, ‘রুগালা’র মতো ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। দুপুরের বিরতির পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে নিজস্ব ভাষায় গান গেয়ে শোনান গারো শিল্পীরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল গারোদের ঐতিহ্যবাহী জুম নাচ। উৎসবে উপস্থিত গারোরা জানায়, ওয়ানগালা একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। ওয়ানগালা উৎসব পাহাড়ি জুমচাষকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয়ে থাকে। নতুন ফসল তোলার পরে নকমা (গ্রামপ্রধান) সবার সঙ্গে আলোচনা করে অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করেন। শুক্রবার রাজধানীর বটমূলী অর্ফানেজ টেকনিক্যাল স্কুল প্রাঙ্গণে ঢাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার গারো। এ উৎসব পালন করে। শহুরে জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দিনভর তারা নিজেদের মতো করে আনন্দে মেতে থাকে। স্কুল মাঠে গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন পণ্যের অস্থায়ী স্টল। ও সব স্টলে স্থান পায় গারো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পোশাক, খাবার, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। খাবারের দোকানে ঘুরে ঘুরে তারা স্বাদ নেয় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবারের। কেউ কেউ বাসায় খাবার জন্য কিনে নেন জুমের আলু, কুমড়া, শামুক, কাঁকড়া।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: