ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার

ধূলি দূষণের কবলে ঢাকা মহানগরী ॥ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

ধূলি দূষণের কবলে ঢাকা মহানগরী ॥ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ

শাহীন রহমান ॥ শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই ঢাকার বাতাসে ধূলিকণার আধিক্য দেখা দিয়েছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুম বাদ দিলেও সারাবছরই ঢাকার বাতাস ধূলিকণায় আচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু এবার শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগে ধূলিকণার পরিমাণ এত বেড়ে গেছে খালিমুখে চলাফেরা করাই দায় হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের উন্নত শহরগুলোতে ধূলিকণার হাত থেকে রক্ষার জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। অথচ নগরে বসবাসকারী জনগণের সুবিধা অসুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এ সংস্থার। আবহওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, গত অক্টোবরের পরে দেশের কোথাও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত নেই বললেই চলে। তাদের হিসাব মতে, নবেম্বরে স্বাভাবিকের চেয়ে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৯৮ ভাগ কম। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম চলে যওয়ার পরপরই বৃষ্টিপাত একেবারেই কমে গেছে। ডিসেম্বর মাসে বৃষ্টিপাতের কোন সম্ভাবনা নেই। আগামী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মসে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা বলা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হবে। আবহাওয়াবিদদের মতে, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাদের মতে, অন্যান্য বছরের নবেম্বরে বৃষ্টিপাতের দেখা মিললেও এবারে তা হয়নি। শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই এভাবে বৃষ্টিপাত না হওয়ার প্রভাব ইতোমধ্যে রাজধানীবাসীর ওপর পড়তে শুরু করেছে। ঢাকার বাতাসে ধূলিদূষণ বা ধূলিকণার আধিক্য অনেক বেশি হওয়ায় স্বাভাবিক চলাচল কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে যানবাহনে চলতে গেলে সহজেই এসব ক্ষতিকর ধূলিকণা চোখে মুখে ঢুকছে। আবার ফুটপাতে চলতে গেলেও রেহাই মিলছে না এর হাত থেকে। বৃষ্টিপাত না হওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্ম। বিশেষ করে ফ্লাইওভার নির্মাণ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার না করা এবং ধূলিবালি নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কোন উদ্যোগ না থাকায় এবারে ধূলির পরিমাণ অনেক বেশি। রাজধানী ঢাকার কয়েকটি জায়গায় সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব এলাকায় নাক মুখ না ঢেকে চলাচল করা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বাংলামোটর থেকে মগবাজার হয়ে মালিবাগ পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের জন্য ব্যাপক ধূলিকণা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব এলাকায় খালিমুখে চলাচল করা খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মেঘের মতো ধূলিকণা উড়তে দেখা যায়। ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক গাবতলীর বেড়িবাঁধ হয়ে মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার হয়ে বাবুবাজারের কাছে গিয়ে মিশেছে। সংস্কারের অভাবে রাস্তাটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত ধূলি উড়িয়ে চলাচল করছে পরিবহনগুলো। দেখার যেন কেউ নেই। আশপাশের বাসিন্দাদের অভিযোগ ধূলির কারণে বাসাবাড়িতে বাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব বাড়িতে শিশুরা রয়েছে তাদের জন্য বিষয়টি আরও ভয়াবহ। সরেজমিনে দেখা গেছে সংস্কার না হওয়ায় বেড়িবাঁধের রাস্তাটি ধুলোয় ঢেকে আছে। এছাড়া রাস্তার দু’পাশে রয়েছে ইট ও বালির বিশাল ব্যবসা। গাবতলীর বিআইডব্লিটিএর লঞ্চঘাট হতে মোহাম্মদপুর সøুইজগেট পর্যন্ত রয়েছে কয়েকশ’ পাথর ভাঙ্গার মেশিন। পাথর ভাঙ্গার কারণে প্রতিনিয়ত এসব এলাকায় ধূলিতে অন্ধকার হয়ে থাকে। সøুইজগেটের পাশের এক দোকানদার আমজাদ হোসেন বলেন, এ এলাকায় একটু বাতাস হলেও ধুলায় টেকা মুশকিল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় যখন পরিবহনগুলো ধূলি উড়িয়ে চলাচল করে। এ সময় আর নাক মুখ না ঢেকে থাকা যায় না। তিনি জানান, এ এলাকার লাখ লাখ বাসিন্দা ধুলোবালিতে অতিষ্ঠ হয়ে বসবাস করলেও দেখার কেউ নেই। শুধু মগবাজার, মালিবাগ, বাংলামোটর, ঢাকার বেড়িবাঁধ এলাকা নয়। বলতে গেলে পুরো ঢাকাই ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। অথচ স্বাস্থ্যের জন্য এটি ক্ষতিকর হলেও দেখার কেউ নেই। নগরবাসীর অভিযোগ শুধু রাস্তাঘাটে চলাচলে নয় ধূলির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না বাসা বাড়িতেও। মুহূর্তের মধ্যে বাসাবাড়ির আসবাবপত্র জরুরী জিনিসপত্র ধূলিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। দ্রুত ছুটে চলা পাবলিক পরিবহনগুলোতে হঠাৎ ব্রেক কষলেই ভেতরে থাকা যাত্রীরা ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রিকশায় চলতে গেলেও সব সময় মুখে রুমাল অথবা আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতে হচ্ছে। কেউ এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকা মহানগরীতে নানা রকম দুর্ভোগের মধ্যে ধুলা-বালির দূষণ অন্যতম। নগরের পথে-প্রান্তরে ধূলিকণা অস্বাভাবিক হারে নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণের কারণে অনেক মানুষ যক্ষ্মা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, চোখের নানারকম রোগ, চর্মরোগসহ অসংখ্য জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের মতে অন্যান্য পদার্থের মধ্যে ভাসমান ধূলিকণাও বায়ুর একটি অন্যতম উপাদান। একটি ধূলিকণার আকার ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি হলে তা বায়ুতে ভেসে বেড়াতে পারে না। ছোট আকারের ধূলিকণাই বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং দূষণ ঘটায়। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এ রকম ২০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ধূলিকণা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তার বেশি হলেই তাকে ধূলিদূষণ বলা হয়। ঢাকা মহানগরীর বাতাসে বর্তমানে এই ধূলিকণার পরিমাণ এত অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে যে তা দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রাকে অতিক্রম করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুষ্ক মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার অধিকাংশ সড়ক এভাবে খোঁড়াখুঁড়ি, সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ব্যাপকহারে ধূলিকণার জন্ম নিচ্ছে। বাতাসে মিশে তা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য এ ধূলিকণা ক্ষতিকর হলেও তা রোধে নগর কর্তৃপক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসছে না। জানা গেছে ঢাকা সিটি করপোরেশনে বর্জ্য বিভাগ থেকে এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তায় ঝাড়ু দেয়ার ব্যবস্থা করা হলেও কখনও পানি ঢেলে রাস্তা পরিষ্কার করার কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাদের মতে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়া ঢাকার বেশিরভাগ রাস্তাই ভাঙ্গাচোরা। সেসব জায়গা থেকেও ধূলির সৃষ্টি হচ্ছে। আবার নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে আসা উচ্ছিষ্ট থেকেও ধুলাবালিতে ভরে যাচ্ছে সড়ক। পরিবেশ সংগঠন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। সর্বগ্রাসী ধূলিদূষণে নগরবাসী এখন অতিষ্ঠ। অবিলম্বে ধূলিদূষণ বন্ধে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন জরুরী। ধূলিদূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা তৈরির জন্য সরকার, বেসরকারী সংগঠন ও সচেতন মহলকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ধূলিদূষণের প্রতিরোধ ব্যবস্থায়- নিয়ম মতো রাস্তা পরিষ্কার করতে হবে। তিনি অবিলম্বে ধূলিদূষণ রোধে সরকারকে এ বিষয়ে যথযথ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
×