ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ গোপন বৈঠকের কী দরকার?

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

অভিমত ॥ গোপন বৈঠকের  কী দরকার?

এখন রাজনীতি মানে জনকল্যাণ না রাজনীতিকের আত্মকল্যাণ, তা সহজে অনুমেয়। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনীতিবিদদের হালহকিকত এমনই। তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মানসিকতা তৈরি হয়েছে আমাদের রাজনীতিবিদদের মাঝে। এমন হলে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা থাকবেই। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পথটি যদি নিজেরাই অমসৃণ করে ফেলি, তাহলে এগোব কী করে? বিরোধী দল কিংবা ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের নানা রকম রাজনৈতিক কৌশল থাকবেই। এই কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক দলের ব্যক্তি বা প্রধানÑ যে কোন ব্যক্তি, দল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তি বা দলের সঙ্গেও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এই আলোচনার কোন সুফল না থাকলে লাভ কী? বিএনপি ২০০৬ সালে মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’ করেও সফল হতে পারেনি। ২০০৬ সালে উত্তরা ষড়যন্ত্রে বিএনপিপন্থী বেশ কয়েকজন আমলা অংশগ্রহণ করেছিলেন। মিডিয়ার বদৌলতে সেই আমলাদের মুখ ঢেকে পালিয়ে যাওয়ার ছবি দেশের জনগণ দেখেছিল। ধরা খেয়ে যাওয়া সেই ষড়যন্ত্রের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার হয়ত সতর্কতা অবলম্বন করেছিল দলটি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। এবার অবশ্য মিডিয়াতে কারও মুখঢাকা ছবিও প্রকাশ পায়নি। তবে মধ্যরাতে গোপন বৈঠক করেও লাভ হলো না। এই গোপন বৈঠকের খবর মিডিয়া ঠিক তুলে এনেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সংবাদপত্র তথা মিডিয়াকে ছায়া সরকার বলা হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনের ক্ষেত্রে সদাজাগ্রত মিডিয়ার এমন ক্ষমতার কথা ভুলে গেলে চলবে কেন? মনে রাখা উচিতÑ ছায়া সরকার অন্তত কোন দলের পক্ষে কাজ করবে না। দলের পক্ষে কাজ করবে না বলেই যে কোন অপকৌশলকে তারা প্রকাশ করবেই। অতএব বাংলাদেশে মিডিয়ার ব্যাপক উৎকর্ষতাকে কোন রাজনৈতিক দল উপেক্ষা করতে চাইলে, তা বোকামো ছাড়া আর কিছু হবে না। বিএনপি কেমন করে ভাবলÑ মিডিয়ার এত বেশি স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণের মতো একটি ঘটনা গোপন থাকবে? দলটির নেতারা কেমন করে ভাবেনÑ তাঁদের দলের ভেতরে দলীয় গোপনীয়তা প্রকাশ করার মতো কোন ব্যক্তির উপস্থিতি নেই; যে ব্যক্তি সরকার বা মিডিয়াকে এ ধরনের একটি ঘটনার টাটকা খবর পৌঁছে দেবে না? বিএনপির নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা কি তাহলে ২০০৬-এর ঘটনা থেকে শুধু সতর্কতার অভিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন? আনুষঙ্গিক অন্য বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেননি? এবার অবশ্য মাহমুদুর রহমান লেভেলের কোন নেতার ওপর আস্থা না রেখে বেগম খালেদা জিয়া নিজেই বৈঠকে যুক্ত থেকেছেন, তাই বলে গোপনীয়তার চূড়ান্ত কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন কি ছিল না? তাছাড়া যে প্রক্রিয়া অতীতে ব্যর্থ হয়েছে, সরকার পতনের লক্ষ্যে সেই একই প্রক্রিয়া অবলম্বনের আদৌ কোন যৌক্তিকতা ছিল কি? তাও আবার প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে নয়। বিএনপি হয়ত ১৯৯৬ সালের ‘জনতার মঞ্চ’-এর উদাহরণকে অনুসরণ করতে চেয়েছে। কিন্তু জনতার মঞ্চে প্রশাসনের বাঘা বাঘা আমলা উপস্থিত ছিলেন। আর ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারিতে সংঘটিত ‘গুলশান ষড়যন্ত্রে’ যোগদানকারীদের অধিকাংশই গুরুত্বহীন প্রশাসনিক কর্মচারীদের। এ কারণে ‘গুলশান ষড়যন্ত্র’কে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। হয়ত গুরুত্ব পেতও না, যদি বৈঠকটি মধ্যরাত পর্যন্ত না চলত! তার ওপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেমন বৈঠকের কথা ‘ভিত্তিহীন’, ‘বানোয়াট’ বলে অস্বীকার করছেন, তেমনি বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান স্বীকার করেছেনÑ বৈঠক হয়েছে। মিডিয়া এবং মারুফ কামাল খানের কথাকে কি একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায়? ‘গুলশান ষড়যন্ত্রে’ যোগদানকারী ২৫-৩০ জন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়ে বলেছেন, ‘১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার। অথবা ১৯৭৪ সালের অবসর আইন অনুযায়ী চাকরি ২৫ বছর হয়ে গেলে তাদের অবসরে পাঠাতে পারে।’ শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী এসব সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না হয় গ্রহণ করা গেল, কিন্তু বিএনপি যে কারণে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে তার সমাধান কী হবে? বিএনপির মতো একটি বড় দলকে কি এ ধরনের সমন্বয়হীন পদক্ষেপে মানায়? ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন একটি বড় দলের তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তাদের যে মোটেই জনপ্রিয়তা নেই, তা তো বলা যাবে না। তাহলে তাড়াহুড়া কেন? বরং দলটি যে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে চেষ্টা করছে, তৃণমূল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেÑ সেদিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কারণ দলীয় সংগঠন শক্তিশালী না হলে কোন ধরনের আন্দোলন পালে হাওয়া পাবে না। উদাহরণে উল্লেখ করা যায় দলটির ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র কথা। সংগঠন শক্তিশালী না করে এ ধরনের গোপন বৈঠকের আদৌ দরকার আছে কি? কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তাই কি পারবে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে? তাও তাদের মাঝেও নেতৃত্ব নিয়ে জটিলতার ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে প্রস্তুতি গ্রহণ সত্ত্বেও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী উক্ত গোপন বৈঠকে যোগ দেননি। এমনিভাবে বিএনপির অধিকাংশ আন্দোলনের উদ্যোগ ভেস্তে গেছে তাদের দলীয় কোন্দলের কারণে। তাই সর্বাগ্রে যে কোন মূল্যে এসব কোন্দল ঘোচাতে হবে। তারপর কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা ভাবতে হবে। তবে এ ধরনের হাস্যকর বৈঠকের আয়োজন করে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ না করাই ভালো। স্বয়ং খালেদা জিয়াকেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা ক্ষমতা প্রত্যাশী একটি দলের যে কোন সিদ্ধান্ত হতে হবে সুচিন্তিত। দলের প্রধানকে খুশি করার জন্য কোন উপদেষ্টা বা নেতার পরামর্শ গ্রহণের আগে তাকে দশবার ভাবতে বলব। প্রস্তুতিহীন কর্মসূচী না দিয়ে বরং সরকারের প্রস্তাবিত গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন বিএনপিকে জনগণের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। লেখক : চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
×