ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স এবং সনদ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স এবং সনদ

মাসদেড়েক আগে বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আকম মোজ্জাম্মেল হক বলেছিলেন, একাত্তর সালে যাদের বয়স পনেরো বছর ছিল না, তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য করা যাবে না। এমন ঘোষণা শুনে আমার মনে হলো বিষয়টা তো মেনে নেয়া যায় না। যারা গরুর হাটে নিত্যদিন গরু বেচাকেনা করেন, তাঁরা গরুর কয়টা দাঁত পড়েছে তাই দেখে বলে দিতে পারেন গরুর বয়স কত। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের প্রথম দাঁত পড়া দেখেও মোটামুটি বয়সের হিসাবটা এক প্রকার আন্দাজ করা যায়। কিন্তু ষাট থেকে সত্তর বছর বয়সের একজন মুক্তিযোদ্ধার বয়স তো অমনভাবে নির্ধারণ করা যায় না। আসলে বয়স হলো তিন রকম। যেমন ফিজিক্যাল এজ, সার্টিফিকেট এজ এবং যেদিন আমরা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম ওইদিন থেকে গণনা করা এজ। একজন মানুষের সত্যিকারের বয়স হয়ত পঁচাত্তর বছর। কিন্তু তিনি পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর বয়সের মানুষের মতো সবল, কর্মক্ষম এবং দেখতেও প্রায় তাই। সুতরাং পঁচাত্তর বছর বয়সের মানুষটির ফিজিক্যাল এজ বলতে হবে পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে। সার্টিফিকেট এজ-ই আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ। চাকরি থেকে শুরু করে সরকারী সব কাজেই সার্টিফিকেটে উল্লেখিত বয়সকেই আসল বয়স বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের সত্যিকারের বয়স এবং সার্টিফিকেটে উল্লেখিত বয়স কদাচিত এক হয়। আমরা ম্যাট্রিক অথবা এসএসসি সাধারণত ১৫ থেকে আঠারোর মধ্যে পাস করি। কিন্তু চাকরি পেতে সুবিধা হবে বিবেচনা করে অধিকাংশ স্কুল ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীদের বয়স ১৪ বছর বলে উল্লেখ করে থাকে। আমার ছোট ভাই একাত্তর সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। সে সাহসিকতার সঙ্গেই যুদ্ধ করেছিল। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর। ১৯৭২ সালে সে এসএসসি পাস করে। তখন তার বয়স ১৯ বছর। কিন্তু সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা হলো ওর বয়স ১৪ বছর। আমি একবার নিউইয়র্ক থেকে যাত্রী হিসেবে ঢাকা আসছিলাম। আমার পাশের আসনে বসেছিলেন এক সময়ের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব। কথা প্রসঙ্গে তাঁকে বললাম, আপনি আর আমি সমবয়সী। প্রশ্ন করলেন, কেমন করে বুঝলেন? বললাম, আপনি আর আমি একসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছি। তিনি বললেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় আমার বয়স চার বছর কম দেখানো হয়েছিল। তাই আশা করি আমিই আপনার চেয়ে বয়সে বড়। একবার আমার এক বন্ধু বয়স নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মজার একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। তাদের একজন কমন ফ্রেন্ড প্রেম করে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। কনের বয়স ছিল তখন ১৯ বছর। এ বিয়ে কনের পিতা মানতে পারেননি। তিনি কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, তাঁর মেয়ের বয়স ১৮ বছর হয়নি অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্কা, তাই ওই বিয়ে বৈধ নয়। প্রমাণস্বরূপ তিনি কোর্টে মেয়ের ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট উপস্থাপন করলেন। তখন বরপক্ষের উকিল কোর্টে নথিপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করলেন, কন্যার পিতা মেয়ের জন্মের দেড়বছর আগে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভের জন্য আমেরিকায় যান আর ফিরে আসেন মেয়ের জন্মের এক বছর পর। এর মধ্যে তিনি একবারের জন্যও দেশে আসেননি। ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটের বয়স যদি সত্যি হয় তবে মেয়েটি দাবিদার পিতার নয়। মামলা ডিসমিস হয়ে গেল। পিতাও কন্যা ও জামাতাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এর চেয়েও একটি মজার কথা উল্লেখ করতে পারি। আমি এক সময় বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ছিলাম। আমার এক সিনিয়র পাইলটের সার্টিফিকেটে যে বয়স উল্লেখিত ছিল, তার চেয়ে দু’বছর আগে তার পিতার মৃত্যু হয়েছিল। আমাদের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের মা হলেন আমার খালা। আমার খালা নূরের বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। পরে স্কুলটি সরকারী হওয়ায় আমার খালা সরকারী কর্মচারী হয়ে যান। চাকরির শেষ পর্যায়ে খালাম্মা শিক্ষা অধিদফতরে চাকরি করছিলেন। তখন তাঁর বয়স সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৫৪ বছর ছিল। কিন্তু সত্যিকারের বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। অর্থাৎ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বয়স। খালাম্মার মনে হলো তখন তিনি যদি সার্টিফিকেটের বয়স দেখিয়ে চাকরি করেন এবং সরকারের কাছ থেকে বেতন গ্রহণ করেন, তবে তা হবে অবৈধ। তাই তিনি এ্যাফিডেভিট করে সঠিক বয়স দেখিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। এ বছর ৭ নবেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক সাহেব প্রধান অতিথি হিসেবে বললেন, মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য বয়সের নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকতে পারে না। তিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে একত্রে তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলেরাও যুদ্ধ করেছে। এই বলে নিজেই নিজের বক্তব্য সংশোধন করেন। এর পরেও আমি বলব, আট-নয় বছরের শিশুরা মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। সেটা সার্টিফিকেটে উল্লেখিত বয়সের হিসাবেও না। (চলবে)
×