ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিইসি বললেন সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হলেই তফসিল ঘোষণা

ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে সব মহলে তোড়জোড় ॥ ভিন্ন কথা বললেও ভেতরে ভেতরে বিএনপির জ

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে সব মহলে তোড়জোড় ॥ ভিন্ন কথা বললেও ভেতরে ভেতরে বিএনপির জ

শাহীন রহমান ॥ হঠাৎই বদলে গেছে দৃশ্যপট। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সবাই নড়েচড়ে বসছে। ভেতরে ভেতরে শুরু হয়েছে নির্বাচনী তোড়জোড়। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও এ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। অপরদিকে সব রাজনৈতিক দলের দৃষ্টি এখন ঢাকা সিটি নির্বাচনের দিকে। নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার পাশাপাশি প্রার্থী নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিএনপি এ নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে ভিন্ন কথা বললেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের মেয়াদ না বাড়িয়ে নির্বাচনের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশের পরই সবার দৃষ্টি এখন নির্বাচন কমিশনের দিকে। তারা তাকিয়ে আছে কখন তফসিল ঘোষণা করা হবে। এদিকে দীর্ঘদিন পর মঙ্গলবার আকস্মিকভাবেই সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ডিসিসি নির্বাচনের জন্য কমিশনের প্রস্তুতি রয়েছে। সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হলেই তফসিল ঘোষণার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, সময়ের স্বল্পতার কারণে জানুয়ারিতে ডিসিসি নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এ নির্বাচন করতে হলে কমিশনকে সময় দিতে হবে। অবশ্য সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে কেউ বলছে বিরোধী দলের আন্দোলন দমাতে সরকার কৌশলি ভূমিকা নিতেই নির্বাচনের আয়োজন করতে চাচ্ছে। আবার কোন পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে যে বাধা ছিল তা দূর হলো। তবে যে যাই বলুক প্রধানমন্ত্রীর এক ঘোষণাতেই সবার দৃষ্টি এখন নির্বাচনের দিকে। বিএনপির পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে, সরকার পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি এ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দলের মধ্যে ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ডিসিসি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জানা গেছে, প্রকাশ্যে এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ভিন্ন কথা বললেও দলের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর আগেও খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে তারা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতি তাদের শুরু থেকেই ছিল। ওই চারটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে বিএনপি। জানা গেছে, এবার একই কৌশলে পথ চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বিশেষ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে জয়লাভ করতে পারলে সরকার পতনের আন্দোলন সহজ হবে এই বিবেচনায় নির্বাচনকে তারা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করছে, ৫ জানুয়ারির আগে ঢাকায় আন্দোলন সফল করতে না পারার কারণে ওই নির্বাচন প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়নি। বর্তমানেও তাদের যে সাংগঠনিক সক্ষমতা আছে তাতে আগামীতে সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে দলের ভেতরে। এ কারণে বিএনপি মনে করছে, সরকারকে চাপে ফেলে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে ঢাকাতে বিএনপি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তখন সরকার পতনের আন্দোলন আরও বেগবান করতে পারবে। বিএনপির বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থী নিশ্চিত করা রয়েছে। জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণে নির্বাচনের জন্য মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের নাম বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিএনপির অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সালাম, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনের নামও এ তালিকায় উঠে এসেছে। এছাড়া ঢাকা উত্তরের জন্য প্রার্থী তালিকায় বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আউয়াল মিন্টুর নাম জোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বাড্ডা এলাকার সাবেক ওয়র্ড কমিশনার আব্দুল কায়ুমের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি থাকলেও এখনই তারা প্রকাশ্যে নির্বাচনের পক্ষে মুখ খুলছে না। বরং প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশকে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে ফেরানোর কৌশল হিসেবে উল্লেখ করছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অবৈধ সরকার নিজেদের বৈধতার জন্য এবং বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে সব ধরনের অপকৌশল করছে। এখন জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে এতদিন পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা বলছে। অতীতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের আন্দোলন বন্ধ করা যায়নি। তবে তিনি উল্লেখ করেন, যখন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আসবে, তখন বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত জানানো হবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী উল্লেখ করেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেখ হাসিনার নতুন ‘ছুঁ মন্ত্র’ । এই মুহূর্তে দেশের মানুষ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চায়। কিন্তু শেখ হাসিনা একটার পর একটা ছুঁ মন্ত্রের মাধ্যমে বেড়াজাল সৃষ্টি করছেন। এই মুহূর্তে ডিসিসি নির্বাচন দিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে আওয়ামী লীগ সরকার যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন কোন লাভ হবে না। দেশের মানুষ চায় একটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর থেকেই নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, জানুয়ারিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এ নির্বাচনের জন্য সময়ের প্রয়োজন। তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। আগামী জানুয়ারিতেই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ কারণে জানুয়ারিতে নির্বাচন করতে গেলে পুরাতন ভোটার তালিকা ধরে নির্বাচন করতে হবে। সেক্ষেত্রে এ নির্বাচনে ঢাকার প্রায় ৫ লাখ ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়া ভোটার তালিকা মুদ্রণ, সীমানা নির্ধারণ ও তফসিল ঘোষণার জন্য সময়ের প্রয়োজন। পাবলিক পরীক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তফসিল ঘোষণা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ডিসিসি নির্বাচনের নির্দেশ দেয়ার পর দীর্ঘদিন পরে হঠাৎ করেই মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তিনি বলেন, সংবাদপত্রে দেখলাম জানুয়ারিতে নির্বাচনের কথা। আমরা অনেক আগে থেকেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণে সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দ্রুত সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে কমিশনকে নির্বাচনের অনুরোধ জানাতে পারে। সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা দূর হলে যত দ্রুত সম্ভব কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। তিনি বলেন, বড় পরীক্ষাগুলো চলাকালে কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন এড়িয়ে চলা হয়। এসব বিচেনায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তফসিল ঘোষণার ক্ষেত্রে পরীক্ষার সময়সূচী দেখে প্রস্তুতি নেয়া হবে। ২০০৭ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হলেও নানা জটিলতায় এখনও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। কমিশনের পক্ষ থেকে কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও আদালতে মামলা ও সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে পিছু হঠতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। ২০০৭ সালের মে মাসে ডিসিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রায় দু’বছর ধরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন সাবেক মেয়র বিএনপির ঢাকা মহানগর কমিটির সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। গত ২০১১ সালের নবেম্বরে ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর নামে দুই ভাগ হয় ডিসিসি। এরপরই সাদেক হোসেন খোকাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে দুই সিটি কর্পোরেশনের জন্য আলাদা প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। বর্তমানে অনির্বাচিত প্রশাসক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসকের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কারণে ডিসিসি নির্বাচনের প্রসঙ্গ আবারও সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর নতুন করে এ নির্বাচন গতি পেয়েছে। আইনী জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ডিসিসির নির্বাচন ঝুলে রয়েছে। গত ২০১২ সালে ডিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেও আদালতের নির্দেশের কারণে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ডিসিসি নির্বাচনের ওপর আদালতের দেয়া স্থগিতাদেশও একের পর এক বৃদ্ধি করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৩ মে হাইকোর্টে এ আদেশে ডিসিসি নির্বাচনের ওপর থেকে সব ধরনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আদালতের এ আদেশের ফলে ডিসিসির নির্বাচন নিয়ে সব ধরনের আইনী বাধা দূর হয়ে যায়। ফলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ডিসিসি নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা হয়। আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। কিন্তু আদালতের ওই রায়ের মাত্র ৮ দিনের মাথায় সীমানা সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ে আবারও আটকে যায় ডিসিসি নির্বাচন। কমিশন জানিয়েছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দক্ষিণের ৫৫, ৫৬, ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড ও উত্তরের উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টর থেকে ১৪ নম্বর সেক্টর ও দক্ষিণগাঁও এলাকার একটি মৌজাকে সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের। ইসি জানিয়েছে, সীমানা সংক্রান্ত এ জটিলতা কেটে গেলেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে।
×