ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ ১৮ ডিসেম্বর

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের  আদেশ ১৮ ডিসেম্বর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। আদেশের জন্য ১৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। অন্যদিকে বাগেরহাটের কসাই সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ৫ম সাক্ষী অরুণ দাস জবানবন্দীতে বলেন, সিরাজ মাস্টার আমার বাবাকে কুপিয়ে দুই হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলে এরপর গুলি করে হত্যা করে। জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে আংশিক জেরা করেন। আজ আবার জেরা করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। একই মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এ আদেশগুলো প্রদান করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। আদেশের জন্য ১৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। এর আগে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ওপর শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। এ সময় আসামি পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট আব্দুস ছালাম খান। তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর ১৭ নবেম্বর পটুয়াখালীর রাজাকার বিএনপি নেতা ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন প্রসিকিউশন পক্ষ। তদন্ত সংস্থা দীর্ঘদিন তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরজ্ঞন রায় তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের পাঁচটি অভিযোগ পেয়েছে। ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে মোট একশত ২ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনসহ পাঁচটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আট জনকে হত্যা ও গণহত্যার, চার জনকে ধর্ষণ, তিন জনকে ধর্মান্তর, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তর ৬৪টি ঘর ও দোকান লুট করে আগুন ধরানোর কথা বলা হয়। ফোরকানের বিরুদ্ধে মোট ৩৪ জন সাক্ষী রয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো মধ্যে মুসলীম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিবি এই সকল দলের নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তানের অখ-তার নামে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৬ এপ্রিল দখলদার পাকিস্তানী আর্মি পটুয়াখালীতে রাজাকার বাহিনী, শান্তি কমিটি, আলবদর বাহিনী গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মির্জাগঞ্জ থানার আসামি মোঃ ফোরকান মল্লিক, সাজাহান শিকদার, কাকড়া বুনিয়া গ্রামের আলী আকবর গাজীসহ অন্যদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালী পুরাতন হাসপাতাল ভবনটি ছিল রাজাকারদের থানার প্রধান ক্যাম্প। ডাক্তার দেবেন্দ্র নাথ সরকার ও তার স্ত্রীকে হত্যার পর ডাক্তার বাবুর বাসাটি পিস কমিটির সদস্যরা তাদের থানা প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে। কসাই সিরাজ ॥ বাগেরহাটের কসাই সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ৫ম সাক্ষী অরুণ দাস জবানবন্দীতে বলেন, সিরাজ মাস্টার আমার বাবাকে কুপিয়ে দুই হাতের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলে, এরপর গুলি করে হত্যা করে। জবানবন্দী শেষে আসামি পক্ষের আইনজীবী সাক্ষীকে আংশিক জেরা করেন। আজ আবার জেরা করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। প্রসিকিউশনের পঞ্চম সাক্ষী বাগেরহাটের অরুণ দাস (৫৫) বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৪ মে দুপুরে আসামি সিরাজ মাস্টার তার সঙ্গীয় লোকজন, রাইফেল, রামদা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। বাবা তাদের দেখে দৌড় দেয়। তারা বাবাকে ধরে ফেলে। এরপর সিরাজ মাস্টার আমার বাবাকে রামদা দিয়ে কোপাতে উদ্ধত হলে আমার বাবা তখন দুই হাত দিয়ে রামদার আঘাত ঠেকানোর চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে আসামি সিরাজ মাস্টার আমার বাবার বুকে গুলি করলে আমার বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আসামি সিরাজ মাস্টার ও তার সঙ্গীয় লোকজন চলে গেলে আমি এবং মা বাবার কাছে আসি। তখন আমার বাবা পানি পানি বলে কাতরাতে থাকে। ঐ চিৎকার শুনে আমার মা তার শাড়ির আঁচল পার্শ্ববর্তী ডোবার পানিতে ভিজিয়ে তা আমার বাবার মুখে দেয়। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ পর আমার বাবা সেখানেই মারা যায়।’ এ সময় সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণে তাকে সাহায্য করেন প্রসিকিউটর সাইয়েদুল হক সুমন। অরুণ দাস তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স আনুমানিক ১১-১২ বছর ছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে আমার বাবা চাচারা গ্রামে পাহারা দেয়া শুরু করলে তাদের সঙ্গে আমরাও পাহারায় যেতাম। ১৩ মে ১৯৭১ সালে দুপুর বেলা হঠাৎ গ-গোলের আওয়াজ শুনি। আমার মা আমাকে বলে কেন গ-গোল হচ্ছে বাইরে গিয়ে দেখে আসতে। আমি বাইরে এসে দেখি অনেক লোকজন তাদের কারও কারও হাতে রাইফেল এবং কারও কারও হাতে দা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। বাবা তাদের দেখে দৌড় দেয়। বাইরে থাকা ঐ অস্ত্রধারী লোকগুলোর মধ্যে আমি আসামি সিরাজ মাস্টারকে চিনতে পারি। সাক্ষী তার জবানবন্দীতে আরও বলেন, আমার বাবার খোঁজে আমি এবং আমার মা বাড়ির পার্শ্ববর্তী আমাদের ভিটার দিকে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি যে ইতোমধ্যে আসামি সিরাজ মাস্টার ও সঙ্গীয় রাজাকাররা আমার বাবাকে ধরে ফেলেছে। আর বাবা তখন সিরাজ মাস্টারকে বলে, তোমার সঙ্গে সায়েরা স্কুল মাঠে অনেক বল খেলেছি, আমাকে মেরো না। আমি এবং আমার মা সিরাজ মাস্টারের হাত-পা ধরে অনুরোধ করি আমার বাবাকে না মারার জন্য। কিন্তু আসামি সিরাজ মাস্টারের সঙ্গীয় লোকজন আমাকে ও আমার মাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ‘এরপর সিরাজ মাস্টার আমার বাবাকে রাম দা দিয়ে কোপাতে উদ্ধত হলে আমার বাবা তখন দুই হাত দিয়ে রামদার আঘাত ঠেকানোর চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে আসামি সিরাজ মাস্টার আমার বাবার বুকে গুলি করলে আমার বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আসামি সিরাজ মাস্টার ও তার সঙ্গীয় লোকজন আমার বাবাকে মৃত মনে করে সেখান থেকে চলে যায়। তারা চলে গেলে আমি এবং মা বাবার কাছে আসি। তখন আমার বাবা পানি পানি বলে কাতরাতে থাকে। ঐ চিৎকার শুনে আমার মা তার শাড়ির আঁচল পার্শ্ববর্তী ডোবার পানিতে ভিজিয়ে তা আমার বাবার মুখে দেয়। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ পর আমার বাবা সেখানেই মারা যায়।’ সাক্ষী অরুণ দাস বলেন, ‘এ সময় গ্রামের একজন লোক আমার ও আমার মায়ের কান্নাকাটি দেখে আমাদের কান্নাকাটি করতে নিষেধ করে এবং বলে যে, তোমরা কান্নাকাটি করলে রাজাকাররা আবার আসতে পারে এবং ঐ লোকটি আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী বেতাগা গ্রামে গিয়ে রাতযাপন করি এবং সকাল হলে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। ভারতে গিয়ে সাহার শরণার্থী শিবিরে আগ্রয় গ্রহণ করি। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দিয়েছি। আমি সিরাজ মাস্টারকে আগে থেকেই চিনতাম, আমাদের স্কুল মাঠে তিনি ভলিবল খেলতে গিয়েছিলেন, তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম’। পরে সাক্ষী আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অভিযুক্ত সিরাজ মাস্টারকে শনাক্ত করেন। সাক্ষীর জবানবন্দী শেষে তাকে আংশিক জেরা করেন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।
×