ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

মুখ ঢেকে যায় বিলবোর্ডে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

মুখ ঢেকে যায় বিলবোর্ডে

শিরোনামটি যৎকিঞ্চিৎ ধার করা। জনপ্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ শীর্ষক কবিতার কথা পাঠকের মনে পড়ছে নিশ্চয়ই। এখানে বিজ্ঞাপন শব্দটির পরিবর্তে বিলবোর্ড শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সচেতনভাবেই। বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই। প্রায় যাবতীয় পণ্যের প্রচার ও প্রসারে যা কাজ করে থাকে পৃথিবীজুড়ে। বিলবোর্ডও একজাতীয় বিজ্ঞাপন। তবে এর ধরন কিছুটা আলাদা। অভিধান বলছে, যে কাষ্ঠখ-ের ওপর বিজ্ঞাপন লাগানো হয়, তাই বিলবোর্ড। তবে সাম্প্রতিককালে কাঠ দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য বিধায় হরহামেশাই ব্যবহার করা হচ্ছে চারপাশে বা চারদিকে কাঠের ফ্রেমের ওপর কাপড়ের ক্যানভাস জুড়ে দিয়ে আঁকাআঁকি। আজকাল কম্পিউটারের কল্যাণে এবং উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বড় বড় ডিজিটাল প্রিন্টও হয়ে থাকে বিলবোর্ডের। তবে প্রচারার্থে সেসব জনসমক্ষে টাঙানো হয়ে থাকে বাঁশ বা কাঠের ফ্রেমে। অনেক ক্ষেত্রে লম্বা রশি দিয়ে এপার-ওপার করেও টাঙানো হয় ব্যানার, বিলবোর্ড। আবার দীর্ঘ প্রলম্বিত বিলবোর্ড/ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়া হয় হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে। এ সবই নানা আকারের, নানা প্রকারের হয়ে থাকে। আর, রঙের তো কথাই নেই- একেবারে সাদা-কালো থেকে রংধনুর মতো রঙিন পর্যন্ত! একেবারে বর্ণজাল বর্ণধনুচ্ছটা যাকে বলে আর কী! তবে সর্বশেষ সর্বাধুনিক বিলবোর্ডের খবর জানাচ্ছে সংবাদ সংস্থা এএফপি সেই সুদূর নিউইয়র্ক থেকে। সেখানে টাইমস স্কোয়ারে বসানো হয়েছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল ডিজিটাল বিলবোর্ড। ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট এই বিলবোর্ড দুই কোটি চল্লিশ লাখ পিক্সেলের। যে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম এটি ভাড়া নিয়েছে, তার নাম সার্চ ইঞ্জিন গুগল। সাধে কী আর বলে গুগলি (মড়ড়মষব)! এটি নিউইয়র্ক টাইমস স্কোয়ারের এমন এক স্থানে ও উচ্চতায় বসানো হয়েছে, যেখানে প্রতিদিন গড়ে তিন লাখ পথচারীর চোখ পড়তে বাধ্য। মার্কিনীদের তো সবই বিগ বিগ। সেক্ষেত্রে বিলবোর্ডই বা বাদ থাকে কেন! আর আমাদের দেশে ব্যাপারটা ঠিক উল্টোÑ ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলসংলগ্ন দর্শনীয় ওপরে এবং বিমানবন্দর ও আশপাশে কয়েকটি ডিজিটাল বিলবোর্ড থাকলেও, শতকরা প্রায় ৯৯.৯৯ শতাংশ বিলবোর্ড-ব্যানারই এ্যানালগ। হাতে তৈরি, হাতে আঁকা, হাতে টাঙানো, হাতে ঝোলানো। এমনকি সেগুলো সরানো তথা উৎপাটন করতে হলেও হাতই ভরসা। বিলবোর্ডের পাশাপাশি রয়েছে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, প্রতীকÑ যেমন নৌকা, ধানের শীষ, লাঙল, কাস্তে, মাছ, ঘড়ি, ইত্যাদি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ছোটবড় নির্বাচনে খ্যাত-অখ্যাত বরাদ্দকৃত নির্বাচনী প্রতীকের কথা আর নাই বা বললাম। আমরা কিছুতেই ভেবে পাই না, গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা মেম্বার পদপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের জন্য গুচ্ছের টাকা খরচ করে বিশাল বিশাল ব্যানার-ফেস্টুন-বিলবোর্ডসহ বড় বড় মাছের প্রতীক, দোয়াত-কলম, কলস, ঘড়ি, তালা ইত্যাদি আরও কত কী বানাতে হবে কেন? আমরা অবশ্য ভুলে যাচ্ছি না যে, এর সঙ্গে বিশাল এক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তথা কামার-কুমার-ছুতারসহ অর্বাচীন আর্টিস্টের কর্মসংস্থান-অর্থসংস্থান হয়। এ সবের গুণাগুণ, সুন্দর-অসুন্দর নিয়ে গ্রাম্য চায়ের স্টলে সকাল-সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তুলকালাম আড্ডা; সরগরম তর্ক-বিতর্ক; পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা। এ সবের যৎকিঞ্চিৎ প্রভাব যে নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পড়েও না, তাও বোধকরি ঠিক নয়। তা না হলে নির্বাচন প্রার্থী বিপুল অর্থ ব্যয় করে এসব বানাবে কেন, টাঙাবেই বা কেন? কিন্তু যৎসামান্য সুস্থমস্তিষ্কে যৎকিঞ্চিৎ চিন্তা-ভাবনা করলেই তো প্রায় একবাক্যে সবাই অকপটে স্বীকার করবেন যে, নির্বাচন সারা হলেই তো সকলই গরল ভেল! পথের ধুলায় লুটায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত বিপুলসংখ্যক ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার এমন কি বিলবোর্ড, হ্যান্ডবিল। নির্বাচনের গুচ্ছ গুচ্ছ ব্যালট পেপারই যখন বনে-জঙ্গলে-ভাগাড়ে-ডাস্টবিনে পাওয়া যায়, সেখানে ব্যানার-পোস্টার তো কোন ছাড়! আর খোদা না করুক, নির্বাচনী ফলাফলকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনায় যদি কোন রকমে পক্ষে-প্রতিপক্ষে হৈ-হট্টগোল, মারামারি, ধরাধরি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সর্বোপরি দাঙ্গা-ফ্যাসাদসহ গোলাগুলি চলে, তাহলে তো কথাই নেই। বিলবোর্ডসহ ব্যানার, ফেস্টুনের সংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি, এই যেমন বাঁশ-কাঠ, লাঠি ইত্যাদিই হয়ে ওঠে হাতিয়ার। আর কাপড়-চোপড়, কাগজ-বেড়া-চাটাই ইত্যাদি তাৎক্ষণিক অগ্নিসংযোগের চমৎকার উপকরণ। আমরা অবাক বিস্ময়ে এও লক্ষ্য করেছি যে, এ সময়ে চোখের পলকে কোত্থেকে যেন চলে আসে কেরোসিন, পেট্রোল, ডিজেলসহ দাহ্য বস্তু এবং পরিত্যক্ত টায়ার-টিউব, আনুষঙ্গিক আগুন জ্বালানোর উপকরণসমূহ। ছোটবেলায় ভাবতাম, এসব বুঝি ভূতে জোগায়। এখন বুঝি, আসলে এসব জুগিয়ে থাকে মানুষই। মানুষরূপী ভূত, যারা সদা সর্বদা নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আমরা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এ রকম অসংখ্য ও অগণিত ভূতের অত্যাচার ও নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছিÑজামায়াত-বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ভূতের আছরে। যা হোক, আপাতত প্রসঙ্গটা সীমিত রাখতে চাই বিলবোর্ড-ব্যানার ইত্যাদিতে। রাজধানী ঢাকা এবং বাণিজ্য ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম তো দীর্ঘদিন ছেয়ে আছে রকমারি ব্যানার ও বিলবোর্ডে। এখানে বিখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ তো কোন ছাড়, আমদের মতো নগণ্য পথচারীকেও খুঁজে পাওয়া ভার! মূল নগর-বন্দরকেও এমনকি খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়। শহর-বন্দরের সিল্যুয়েট ঢাকা পড়েছে অনেক আগেই। সুউচ্চ সুদৃশ্য ভবন ও হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো ঢাকা পড়েছে দীর্ঘ প্রলম্বিত ব্যানার-ফেস্টুনে, আড়ালে পড়েছে বিশাল বিশাল বিলবোর্ডের। দিনের বেলায় এ সবের ছায়া-প্রচ্ছায়ায় সূর্যালোক খুঁজে পাওয়া ভার; আর রাতের বেলা চলে অন্ধকারের অবাধ আনাগোনা। এ সময়ে এ অবস্থায় আর কে কাকে মুখ দেখাতে পারে বলুন? রাজধানী ও বন্দরনগরীর বাইরে গেলেও শহরতলী এবং হাইওয়ের দু’পাশে, ত্রিরাস্তা-চৌরাস্তার মোড়ে, আকাশে-মাটিতে, গাছের মাথায়, আশপাশে চোখ আটকে যায় নানাবিধ রকমারি, আকর্ষণীয় ও ঝলমলে বিলবোর্ডেÑ ঝা চকচকে সাংঘাতিক স্মার্ট ও ক্ষুরধার এক তরুণীকে দু’দিক থেকে টানছে দুটো লাফাঙ্গা তরুণÑ কোনও সেলফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন হয়ত বা। সেসব দেখে তো আমরাই ভড়কে যাই প্রায়শই; অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত, অশিক্ষিত চালকের আর দোষ কী? অতএব, মিশুক-মুনীরের অনিবার্য মৃত্যু ঘটে সমূহ সড়ক দুর্ঘটনায়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে অনেকদিন আগে দেখা ফেলিনির একটি ছায়াছবির কথাÑ বোকাচ্চিওর একটি দৃশ্যে দেখা যায়, গির্জার সৌম্য পুরোহিত থুড়ি প্রিস্ট পর্যন্ত বিমোহিত হয়ে চড়ে বসেছে প্রায় এক অর্ধনগ্ন সুতন্বী চিত্রিত সুবিশাল বিলবোর্ডে! একদিন রাত দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে অকস্মাৎ দেখি, ইত্তেফাক-ব্রাদার্স ক্লাবের মোড়ে টাঙানো সুবিশাল এক বিলবোর্ড থেকে সুদেহী দীর্ঘাঙ্গিনী সুতন্বী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া সুললিত হাস্যে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় রাস্তা অবরোধ করে। দু’চোখ কচলে দৃষ্টিবিভ্রম দূর করে আমি তো তখন পালাতে পারলে বাঁচি। হায়, কোথায় প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, আর কোথায় আমি! আগরতলা-চোকিরতলা! জনসভা-মিছিল-মিটিং-সমাবেশ উপলক্ষে বিলবোর্ড-ব্যানারের সংখ্যা বেড়ে যায় আরও বহুগুণ। আওয়ামী-বিএনপি হলে তো কথাই নেই, এমনকি লাঙ্গলের সমাবেশেও দেখি ব্যাপক লোক সমাগম ঘটে। আর জামায়াতের তো কথাই নেইÑ এরা তো দেখি তথাকথিত জেহাদ করার জন্য তৈরি সর্বদাই। তবে ধাওয়া খেয়ে জামায়াতীদের পলায়ন তৎপরতাও দর্শনীয় বৈকি। কোত্থেকে যে ওদের এত টাকা-পয়সা আসে, কে জানে? তো জনসভা উপচেপড়া এত বিপুলসংখ্যক বিলবোর্ড-ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার দেখে কে বলবে আমরা একটি অপেক্ষাকৃত গরিব দেশ ও জাতি? উন্নয়নশীল বটে, তবে সংগ্রাম তো চালাতেই হচ্ছে প্রতিনিয়ত কায়ক্লেশে বেঁচে-বর্তে থাকার জন্য। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেক সময় নির্দেশ দেন, অবিলম্বে এসব অপসারণের। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বিলবোর্ড ব্যানারের অত্যাচার-নির্যাতনে শহর-নগর-বন্দর দূষণ তথা সৌন্দর্য হনন চলছেই অবিরাম, অবিরত। আমরাও ভেবে পাই না, বিলবোর্ড-ব্যানার অপসারণের জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হবে কেন? এর জন্য তো সিটি কর্পোরেশনই যথেষ্ট। বিলবোর্ড-ব্যানার-পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ইত্যাদিকে অবলম্বন করে যৎকিঞ্চিৎ সৃজনশীল শিল্পের উত্থান এবং স্ট্রিট আর্টিস্ট, কম্পিউটার গ্রাফিকসের কর্মসংস্থান সত্ত্বেও বলব, এ সবই অবিলম্বে কমিয়ে আনা এবং অপসারণ করা জরুরী। তা না হলে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্যান্য নগর ও শহরের সৌন্দর্য, তা সে যেখানে যতটুকুই থাক না কেন, আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। আফটার অল, আমরা তো আমাদের বসবাসের শহরটাকে ভালবাসতে চাই, ভালবাসি। শহর-নগর পরিপাটি পরিচ্ছন্ন রাখা তো আমাদের সবার নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা তো সর্বদাই দেখতে চাই দিনের আলো, রাতের জ্যোৎস্না। সঙ্গোপনে প্রেম-ভালবাসা করার জন্য যৎকিঞ্চিৎ আড়াল-আবডাল। সে অবস্থায় আমার মুখ কেন ঢাকা পড়বে বিজ্ঞাপনে? আর আমার ভালবাসার মানুষটির মুখ কেন ঝুলে থাকবে বিলবোর্ডে?
×