ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে মরে গেলেই হয়ত ভাল হতো...

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধে মরে গেলেই হয়ত ভাল হতো...

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ‘দেশটাকে স্বাধীন করেও মোটেই ভাল নেই তিনি। মৃত্যু তাড়া করে বেড়ায় সবসময়। অভাব, অনটন তো আছেই তার ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার আশঙ্কায় রীতিমতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি। মনে হয় স্বাধীনতার সময় শহীদ হলেই ভাল হতো। তাহলে হয়তো নিজ হাতে স্বাধীন করা দেশে স্বাধীনতার শত্রু জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার হতে হতো না। উচ্চ আদালতে জামায়াত-শিবির লক্ষ্য করে গুলতি চালানো আর যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম করায় ক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবির আমার ডান হাতের রগ কেটে দিয়েছে। টাকার অভাবে হাতের সুচিকিৎসা হচ্ছে না। একবার রগ কেটেছে, আবার সুযোগ পেলে হয়তো আমাকেই কেটে ফেলবে। বিজয়ের মাসে অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কথাগুলো বলছিলেন প্রায় ৮২ বছরের বীরসেনানী নূর হোসেন। বললেন, আমার পিতার নাম হারুন আলী (মরহুম)। ঢাকার আজিমপুরের নিউপল্টনের ২০২ নম্বর বাড়িটি আমাদেরই ছিল। বাবা ঘোড়দৌড়ের বাজি খেলতে খেলতে বাড়ি বিক্রি করে দেন। তখন দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের দামামা বাজছে। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায় শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়। আমাদের বাড়ির কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। ওই রাতেই আমি বাড়ি ছেড়ে পালাই। অনেক কষ্টে ময়মনসিংহে পৌঁছি। মাও কয়েকদিন আগে সেখানে যান। আমি আমার মামা ময়মনসিংহের স্টেশন মাস্টার সৈয়দ আমজাদউল্লাহর বাড়িতে আশ্রয় নেই। সেখানে প্রতিদিন ১২ বছরের অধিক বয়সীদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য মাইকিং করা হচ্ছিল। তৃতীয় দিনের মাথায় আমি পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। তারপর যুদ্ধ আর যুদ্ধ। সেসব অনেক ইতিহাস। অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু আমি কি পেলাম! ময়মনসিংহ থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ায় আমার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ময়মনসিংহ জেলা সদরের সানকিপাড়ার ছাতিয়ামতলা গ্রামের ঠিকানায় হয়। আমি সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন যুদ্ধ করেছি। আমার লাল বই মুক্তিবার্তা নম্বর-০১১৫০১০৮৩০। জাতীয় গেজেট নম্বর-১৫৬। ভারতীয় তালিকা নম্বর-১০০১২। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর-০০৩২৫। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা নম্বর-ম-১৯২১৪১। স্বাধীনতার পর পিরোজপুরের মেয়ে মিনারা বেগমকে বিয়ে করি। স্ত্রীর বয়স এখন ষাট। তিন মেয়ের মধ্যে রুমা আর সাজু বেগমকে বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে। অপর মেয়ে মিরপুর বাঙলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী নূরজাহান আক্তার। স্ত্রী আর কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ৫/২৮ নম্বর টিনশেড বাড়িতে মাসিক সাড়ে ৩ হাজার টাকায় গত ৩ বছর ধরে ভাড়ায় থাকছি। কবিরাজিই রোজগারের একমাত্র পথ। বললেন, সবকিছু ভালভাবেই চলছিল। ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতা লাভের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। আমার আনন্দ আর দেখে কে! যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমি অংশ নেই। মনের অজান্তেই নেমে পড়ি। মিছিল মিটিংয়ে সেøাগানসহ সবকিছুতে অংশ নিতে থাকি। যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালত এলাকায় সরকার সমর্থক ও বিএনপি-জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ডের আমরা প্রায় সবাই অংশ নেই। আমি জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের লক্ষ্য করে গুলতি চালাতে থাকি। ওই সময় এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে চলমান আন্দোলনেরও আমার অনেক ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। তখন থেকেই জামায়াত-শিবির আমার পিছু নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরের ২ অক্টোবর আমার ওপর হামলা হয়। ওইদিন আমি সকালে ১০, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ইসমত কাদির গামার সঙ্গে দেখা করে মিরপুরের বাসায় ফিরছিলাম। আমি যাত্রীবাহী দিশারী পরিবহনের একটি বাসে ছিলাম। তখন দুপুর আনুমানিক সোয়া বারোটা। আমাদের বাসটি ফার্মগেটের কাছে পৌঁছলে পেছন থেকে যাত্রীবাহী শিখর পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১১-১৮৭৯ নম্বরের একটি বাস তাদের বাসের পিছু নেয়। পরিকল্পিতভাবে বাসটি আমাদের বাসকে মেরে দেয়। আমাদের বাস বিষয়টি আমলে না নিয়ে চলতে থাকে। বাসটি আবার ফার্মগেটের কাছে এসে আমাদের বাসটিকে ধাক্কা দেয়। আমাদের বাসটি দাঁড়ালে ওই বাস থেকে ১০-১২ জামায়াত-শিবির কর্মী তারা তাদের বাসে উঠে পড়ে। উঠেই তারা যাত্রীদের মারধর শুরু করে। আমাকে দেখেই কয়েকজন এগিয়ে যায়। হামলাকারীরা বলে, নিজামী-সাঈদীর ফাঁসির দাবির আন্দোলনে ওই লোকটি (আমি) সব সময় থাকে। তাকে আগে ধর। বলেই হামলাকারীরা আমাকে বেধড়ক মারধর শুরু করে। বাস চলতে থাকায় হামলাকারীরা ঝাঁকুনিতে সুবিধে করতে পারছিল না। তারা বাসের ভেঙ্গে পড়া কাঁচ দিয়ে আমার ডান হাতের রগ কেটে দেয়। বাধা দিতে গেলে বাসের হেলপারের পাঁচটি আঙ্গুল কেটে যায়। তারা চালককেও বেধড়ক মারধর করে। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা চালাতে গিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। চিকিৎসার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বরাবর একটি আবেদনও করেছি। আক্ষেপে কেঁদে ফেলে তিনি বলেন, অভাব, অনটন আর জামায়াত-শিবিরের হামলার আশঙ্কায় রীতিমতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি। স্বাধীনতার সময় শহীদ হলেই ভাল হতো। তাহলে হয়তো নিজ হাতে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার শত্রু জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার হতে হতো না। টাকার অভাবে আমার সুচিকিৎসা হচ্ছে না। আবার সুযোগ পেলে হয়তো আমাকেই কেটে ফেলবে। নূর হোসেনসহ যাত্রীবহনকারী ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২০৭৩ নম্বরের সেই দিশারী পরিবহনের চালক দুলাল ভূঁইয়া (৪২) ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, ওদিন শিখর পরিবহনের বাসটি পরিকল্পিতভাবে তার বাসটিকে প্রথমে পেছন থেকে কারওয়ানবাজারে ধাক্কা দেয়। সামান্য ধাক্কা দেয়ার কারণে আমি প্রতিবাদ না করে চলে আসি। এরপর আবার বাসটি ফার্মগেটের কাছে এসে পেছন থেকে ইচ্ছে করেই মারাত্মকভাবে ধাক্কা দেয়। আমি বাসটি দাঁড় করাই। এ সময় ওই বাস থেকে যুবক ও মাঝবয়সী ১০/১২ জন নেমে বাসে ঢুকেই যাত্রীদের বেধড়ক মারধর শুরু করে। বাধা দিতে গেলে তাঁকেও মারধর করে। বাধা দেয়ার সময় হেলপারের পাঁচটি আঙ্গুল কেটে যায়। আহত হয় ৫/৭ জন। হামলাকারীরা জানালার ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচ দিয়ে নূর হোসেনের ডান হাতের রগ কেটে দেয়ার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি দেখে গাড়ি চালাতে শুরু করলে হামলাকারীরা দ্রুত নেমে পালিয়ে যায়। বীরসেনানী নূর হোসেনকে সহায়তা করার বিকাশ নম্বর-০১৯২৩-৭৪৪-৮৯০।
×