ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রণেশ মৈত্র

মুক্তিযুদ্ধ ও কমরেড অমূল্য লাহিড়ী

প্রকাশিত: ০৩:০৭, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধ ও কমরেড  অমূল্য  লাহিড়ী

( শেষাংশ) দ্বিতীয়ত. বিচারক পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন লঁফরপরধষ সরহফ সম্পন্ন ব্যক্তি এবং আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিচারকালে আদালত অমূল্য দা’কে জিজ্ঞেস করেন, ওই পতাকা কেন তাঁর বাড়িতে পাওয়া গেল। তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কিছুকাল পাকিস্তান পূর্বকালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক থাকার কথা এবং সেই সুবাদে পতাকাগুলো বাসাতেই থেকে যাওয়া এবং তার পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রী ওই পতাকার কাপড়গুলো দিয়ে বালিশের খোল বানানোর কথা বলেন। আদালত তা স্বাভাবিক বিবেচনা করে অমূল্য দা’র বক্তব্য সত্য বলে গ্রহণ করেন। বোমার ব্যাপারটিতে দেখা গেল একটি খালি কৌটা এবং তার মধ্যে দুটি ব্যবহৃত টর্চলাইটের ব্যাটারি এবং সামান্য কিছু তার ওই কৌটায় ঢোকানো। পুলিশ তাকেই বোমা বলে উল্লেখ করে আলামত হিসেবে আদালতে দাখিল করে। আদালত তা পূর্বেই যথারীতি বোমা বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করে তার রিপোর্টে বিষয়টি যে আদৌ বোমা নয় বরং সবই ফেলে দেয়া ব্যবহৃত জিনিস তা উল্লেখ করায় অমূল্য দা’কে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে (যিনি ওই মামলার বাদী) রীতিমতো প্রকাশ্যে গালাগাল করে আর কাউকে এভাবে হয়রানি না করতে নির্দেশ দেন এবং করলে চাকরিচ্যুতির ভয়ও দেখান। তবুও এ দফায় তাঁকে প্রায় তিন বছর হাজত খাটতে হয়। এবং তাঁকে জীবনে সম্ভবত সাকুল্যে প্রায় দীর্ঘ ২৫-২৬ বছর জেলেই কাটাতে হয়। অমূল্য দা, বৌদি, মেয়ে আপেল ও অঞ্জলি এবং দুই ছেলে নিয়ে গঠিত ওই সংসার। জীবনের বিশাল অংশ জেলে কাটাতে হওয়ায় এবং অপরদিকে সাংগঠনিক রাজনৈতিক, কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ততাজনিত কারণে সংসারের প্রতি উপযুক্ত নজর দিতে পারেননি এটা যেমন সত্য, তেমনি আবার এ কথাও সত্য যে, যতদিন সংসারের একজন হয়ে বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছেন ততদিনই তিনি ছিলেন তাঁর সংসারের একজন যোগ্য অভিভাবকও। গ্রামের এবং আশপাশের এলাকার মানুষের একজন প্রিয় ‘বাবু’ এবং তাঁরা ‘বাবু’ বলেই ডাকতেন তাঁকে। এই ডাকের মধ্য দিয়ে তাঁর পারিবরিক সামন্ত জমিদারি পরিচিতির গন্ধও দিব্যি ফুটে ওঠে। সকল কমরেডই তাঁর কাছে ছিল প্রায় সন্তানতুল্য। কারণ সবার সঙ্গেই বয়সের ফারাক ছিল অনেক। প্রকৃত প্রস্তাবে অমূল্য দা’র রাজনৈতিক জীবন শুরুর সময় থেকে মধ্যজীবন পর্যন্ত যাঁরা তাঁর সহকর্র্মী বা সমসাময়িক ছিলেন পাবনা জেলায়Ñ মৃত্যু অথবা দেশত্যাগজনিত কারণে তাঁদের কেউই আর এদেশে নেই। তাঁর এমন পিতৃসুলভ আচরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে আমি তাঁদের অন্যতম। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে পাকবাহিনী গভীর রাতে এসে পাবনা শহরকে তাদের দখলে নেয়। পাবনার তদানীন্তন জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি আমজাদ হোসেন এমএনএর নেতৃত্বে ছাত্র-যুবক-পুলিশ-আনসার সমবায়ে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর সুকৌশল যুদ্ধ পরিচালনায় পাবনাতে আগত দুই শত পাকসেনা ও কর্মকর্তাকে খতম করে ২৯ মার্চ পাবনা মুক্ত হয়। দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী) ওই প্রতিরোধ যুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রাখেন। তখন এই শক্তিগুলো সমবায়েই গঠিত হয়েছিল একটি হাইকমান্ড। পাবনা মুক্ত করার ব্যাপারে প্রতিরোধ যুদ্ধে পদ্মার চরে অধিবাসী হাজার হাজার কৃষকের অংশগ্রহণ নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল। হাই কমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ এপ্রিল আমি আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেনসহ কলকাতা যাইÑ উদ্দেশ্য দ্বিতীয় হামলা প্রতিরোধের জন্য ভারি অস্ত্র ও প্রশিক্ষক সংগ্রহ করে আনা। দেখা হয় কৃষক নেত্রী কমরেড ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী কমরেড রমেন মিত্রের সঙ্গে। তাঁরা কমরেড বিশ্বনাথ মুখার্জির মাধ্যমে দেখা করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর সঙ্গে। তিনি জানান, বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানাবেন এবং তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। দিল্লী থেকে ডেকে পাঠানো হলো আমাদের। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বললেন, কেন্দ্রের প্রতিনিধি বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়ে আসছেন কলকাতায়। অপেক্ষাও করতে পারেন। আমরা অপেক্ষা করলাম, ইতোমধ্যে ১০ এপ্রিল পাবনার দ্বিতীয় দফা পতন ঘটে যায়। অমূল্য দা তখনও কলকাতা পৌঁছাননি। ইলা মিত্রের বাড়িতেই দেখা হলো কমরেড মনি সিংহের সঙ্গে। মনি দা পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত জানালেন। বললেন, নিজ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় গিয়ে রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প স্থাপন করতে। দেশ থেকে আসা ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সমর্থকরা সেখানে থাকবেন পরে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্রসহ দেশে পাঠানো হবে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। সে অনুযায়ী শামসুজ্জামান সেলিমসহ গেলাম নদীয়া জেলার করিমপুরে একটি টিনের চালাঘর ও আঙ্গিনাসহ ভাড়া নিয়ে পাবনা জেলার ন্যাপ, সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ যুবশিবির স্থাপন করি। পরিচালনার দায়িত্ব আমার ওপর থাকল রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্বসহ। ইতিমধ্যে অমূল্য দা কলকাতা পৌঁছে খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখা করেন এবং তরুণদের উৎসাহিত করেন। তিনি অবশ্য কলকাতা থাকলেন। এভাবে নয় মাসব্যাপী কয়েক শ’ তরুণকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে করিমপুর ক্যাম্প থেকে সামরিক প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। কমরেড প্রসাদ রায় জুন মাস নাগাদ করিমপুর ক্যাম্পের অন্যতম দায়িত্ব নিয়ে আসেন। সেই থেকে দু’জন মিলে ক্যাম্প চালাতাম। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার পর ২৫ ডিসেম্বর আমরা করিমপুর ক্যাম্প তুলে দিয়ে ট্রাকে চড়ে আমরা সরাসরি চলে আসি মুক্ত স্বাধীন পাবনায়। দেশে ফিরে এসে অমূল্য দাসহ আমরা পার্টি পুনর্গঠন ও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করি। অমূল্য দা ন্যাপের সভাপতির দায়িত্ব ত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ওই দায়িত্ব তিনি পালন করেন। ৎধহবংযসধরঃৎধ@মসধরষ.পড়স
×