কাওসার রহমান, পেরু (লিমা) থেকে ॥ হঠাৎ করেই বদলে গেল সব পরিবেশ। সকাল থেকেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল সবকিছু। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির কাঠামোতে সব দেশ মিলে এত প্রস্তাব দিয়েছে যে, পাহাড়সম সেই প্রস্তাবগুলো একত্রিত করে সবার খুশিমতো একটি কাঠামো তৈরি করা একদিনের মধ্যে সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছিল বৈকি। ঝড়ের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে এসে সেই পরিবেশ বদলে দিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।
প্রেসিডেন্ট ওবামার পর কোন জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তির পদচারণায় হঠাৎ করেই বদলে যায় লিমা জলবায়ু সম্মেলনের পরিবেশ। শুধুু পদচারণায়ই নয়, বৃহস্পতিবার সকালে এসে একটি সাইড ইভেন্টে যোগ দিয়ে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে উন্নত দেশগুলোর দফারফা করলেন তিনি। বললেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করা বন্ধ করুন। সেইসঙ্গে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বেশি কার্বন নির্গামনকারী কয়লা ব্যবহার করে সস্তায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ পরিহার করুন।
তিনি সম্মেলনে যোগদানকারী সব দেশের উদ্দেশে বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে লিমার আলোচনা একটি সম্মিলিত প্রয়াস। এই সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা গ্রহণে কোন অজুহাত দেবেন না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রয়াসকে অবহেলা করলে তা হবে ঐতিহাসিক নৈতিক ব্যর্থতা’।
জন কেরি আরও বলেন, ‘লিমায় আমরা যদি নেতৃত্ব না দেই তাহলে ভবিষ্যত প্রজম্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই নতুন পথের দিকে যেতে আমাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সংবাদ সস্মেলনে জন কেরি তার দেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও কঠোর সমালোচনা করেন, যারা জলবায়ু পরিবর্তনে বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে বিশ্বাস করছে না। তিনি বলেন, বিজ্ঞানীদের ৯৭ ভাগ গবেষণাই বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি সত্যি এবং বাস্তব ঘটনা। এটি ঘটে চলেছে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তন মানবসৃষ্ট। এটা ঘটছে জৈব জ্বালানি পুড়িয়ে অতিমাত্রায় গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের কারণে। বিশ্বে যে পরিবর্তন ঘটছে এটা অনুধাবন করতে ডক্টরেট ডিগ্রীর প্রয়োজন হয় না।
তিনি বলেন, কোন একক দেশের পক্ষে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক জাতিকে এজন্য দায়িত্ব নিতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে বারাক ওবামা ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দেন এবং একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার প্রচেষ্ঠা কোপেনহেগেন এ্যাকর্ডে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রী থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার স্থান পায়। বারাক ওবামার পর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি পেরু জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। কার্বন নিঃসরণ কমাতে চীনের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরের পর পেরু জলবায়ু সম্মেলনে তার সরাসরি উপস্থিতি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। শেষ পর্যন্ত লিমা থেকে একটি ফল বেরিয়ে আসবে এমনটাই আশা করা হচ্ছে।
কঠিন কাজ ॥ শেষ মুহূর্তে এসে লিমা জলবায়ু সম্মেলনে একটি এজেন্ডাই প্রধান হয়ে উঠেছে। সেটি হচ্ছে ২০১৫ সালে প্যারিসে সব দেশকে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আইনী কাঠামো চূড়ান্ত করা। গত সোমবার সকালে এ কাঠামোর একটি খসড়া বের হয়। তার ওপর গত দুইদিন সদস্য দেশগুলো তাদের মতামত দিয়েছে। সেই মতামতগুলোকে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে আরও একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ওই খসড়ার এক একটি প্যারায় এত প্রস্তাব এসেছে যে, সেগুলোকে সমন্বয় করে একটি চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা কমিটির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ প্রত্যেক ক্লজেই সদস্য দেশগুলো তাদের প্রস্তাব দিয়েছেন।
দুটি ওয়ার্কিং গ্রুপ সম্মেলন শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে মাত্র একটি প্যারা সর্বসম্মতভাবে ঠিক করতে পেরেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্যারা ৩৪ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ সকল দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তাদের সম্পৃক্ততা জোরালো করবে।
ফলে নির্ধারিত সময় শুক্রবার বিকালের মধ্যে এ খসড়া কাঠামো চূড়ান্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় নিগোসিয়েটররা পেরু সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছে। একাধিক গ্রুপে এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে কাজ কঠিন হলেও লিমা সম্মেলন থেকে একটি ফল বেরিয়ে আসবে সেই সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছে। কারণ এখন পর্যন্ত লিমার আলোচনায় ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে না হলেও শুক্রবার মধ্যরাতে কিংবা শনিবার ভোর নাগাদ লেগে যেতে পারে লিমার জলবায়ু সম্মেলনের ফল পেতে।
সংসদীয় কমিটির তৎপরতা ॥ পরিবেশ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বৃহস্পতিবার নেপালের পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, মাউন্টেন ফোরাম এবং ডেনমার্কের পরিবেশবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির প্রধান ড. হাছান মাহমুদ এ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। আর নেপালী কংগ্রেসের ছয় সদস্য এ বৈঠকে যোগ দেন।
নেপাল ও বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে হিমালয়ের পানিসম্পদকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশই যাতে সুফল পেতে পারে সে ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করা হয়।
বৈঠকে বলা হয়, নেপালে এক লাখ ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। নেপালে ওই বিদ্যুত তৈরি করে তা বাংলাদেশে কিভাবে নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
মাউন্টেন ফোরামের বৈঠকে উজান থেকে আসা পানির প্রভাব নিয়ে কাজ করতে সার্ক এনভায়রনমেন্টাল নেটওয়ার্ক গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
আর ডেনমার্ক সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: