ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব শুরু

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সম্প্রীতির সমাজ গড়ার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সম্প্রীতির সমাজ গড়ার স্বপ্ন

মোরসালিন মিজান ॥ ছোটখাটো কিছু নয়। বিরাট বিশাল অর্জন। নয় মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম। কান্না। এক নদী রক্ত। তারপর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আত্মত্যাগের বিরল ইতিহাস রচনা করে ‘নয়া বাংলার নয়া সকাল’ দেখেছিল বাঙালী। বছর ঘুরে আবারও আসছে সেই বিস্ময়কর সকাল। বাঁধভাঙা আনন্দের দিনটি আসছে। প্রতিবারের মতো ‘এইদিনÑ/ সৃষ্টির উল্লাসে হবে রঙিন।’ সে লক্ষ্যে ডিসেম্বরের প্রথম দিবস থেকেই শুরু হয়ে গেছে উৎসব অনুষ্ঠান। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার থেকে শুরু হলো সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিকেলে ঢাকার সবচেয়ে বড় আয়োজনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। প্রতিবারই একটু গভীরতর ভাবনা থেকে এ আয়োজনের উদ্বোধক নির্বাচন করা হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বিজয় উৎসব ২০১৪ উদ্বোধন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকমর্তা প্রসিকিউটর ও সাক্ষীদের একটি দল। সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন তাঁরা। অনুষ্ঠান থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি সংগঠন হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের জোর দাবি জানানো হয়। উৎসবের এবারের সেøাগান তাই ‘যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে ধার্য/গণহত্যাকারী সংগঠনের বিচার অনিবার্য।’ আয়োজনের শুরুতে বাহান্ন ও একাত্তরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এর পর এক মিনিটের নীরবতা। সরব হতেই আবেগঘন কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। দলীয় সঙ্গীতে অংশ নিয়ে শিল্পীরা সুরে সুরে জানিয়ে দেনÑ কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে...। এ পর্যায়ে ঘোষণা পাঠ। নাতিদীর্ঘ উৎসব ঘোষণায় মফিদুল হক বলেন, দীর্ঘ তমসার অবসান ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত জাতি আবার উর্ধ্বে তুলে ধরছে স্বাধীনতার গৌরবদীপ্ত পতাকা। এর পরও স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র করছে উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলতে ব্যাপকতম জাতীয় ঐক্য নির্মাণের আহ্বান জানান তিনি। অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কবি মুহম্মদ সামাদ, ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ। জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। তবে মাইকের সামনে নতুন মুখ ছিলেন উৎসবের উদ্বোধক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসলি রানা দাসগুপ্ত, জেয়াদ আল মালুম ও সাক্ষী শিরু বাঙালী। এদিন বিশেষ নজর কাড়েন শিরু বাঙালী। তাঁর সহজ ভাষা। সরল উপস্থাপনা। ফলে আলোচনা পর্বে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। শিরু গর্ব করে বলেন, আমি জীবনে দুটি বড় কাজ করেছি। ১৯৭১ সালে দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আর তারপর স্বাধীন দেশে সেই পুরনো শত্রুদের বিচার নিশ্চিত করতে মামলার সাক্ষী হয়েছি। সাক্ষী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাকা চৌধুরী ভয়ঙ্কর খুনী। একাত্তরে চট্টগ্রামে যে নৃশংসতা সে চালিয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। স্বাধীন দেশেও কম ভয়ঙ্কর ছিল না এই ব্যক্তি। আর তাই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে গিয়ে প্রথমে একটু সংশয় সন্দেহে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে সাক্ষী দিতে দাঁড়িয়ে মনে কোথা থেকে এত বল পেলাম জানি না। আমি প্রমাণ করতে পেরেছি, সাকা চৌধুরী কাগুজে বাঘ। সাক্ষী না দেয়ার শর্তে তাঁকে বড় অঙ্কের টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আমি একসঙ্গে ১ লাখ টাকাও কোনদিন চোখে দেখিনি। অথচ ১ কোটি টাকার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। এ কারণেই আজ এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি। এটাই আমার জন্য বড় সম্মান। এ সময় উপস্থিত সকলে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কারী আবদুল হান্নানের আলোচনা থেকেও কিছু জরুরী বিষয় উঠে আসে। তিনি বলেন, বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পরও আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে হচ্ছে। আমি এই বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সামান্য ভূমিকা রাখতে পারছি। এটি আমার পরম সৌভাগ্য। এর পরই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ। বলেন, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাক্ষী হয়েছেন তাঁরা একেবারেই সাধারণ মানুষ। কারও থাকার জায়গা নেই। ঠিক মতো খেতে পায় না। এই শীতের রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারে না। তাঁদের পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। দুঃখ করে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তথাকথিত শিক্ষিতরা যুদ্বাপরাধীদের বিচার হোক এটা চেয়েছেন অবশ্যই। নিজে সাক্ষী হতে আসেননি। বহু অধ্যাপক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হতে পারতেন। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করেননি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা এদিন দীর্ঘ আলোচনায় যাননি। মূলত যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁদের ভূমিকার প্রশংসা করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। ট্রাইব্যুনালের যোদ্ধারা আইনকে অস্ত্র করে লড়ছেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, বিচারকার্য এগিয়ে নিতে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তাঁদের জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে চলছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। শিল্পীরা নাচ গান ও কবিতার ভাষায় তুলে ধরছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে। আজ রবিবার থেকে একযোগে উৎসব চলবে টিএসসি সড়ক দীপ, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু কিশোর মঞ্চ, ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর, রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত উৎসব চলবে মিরপুর, উত্তরা ও ধনিয়া মঞ্চে। জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, উৎসবে শতাধিক সংগঠনের তিন হাজার শিল্পী অংশ নেবেন। প্রতিটি মঞ্চে চলবে মুক্তিযুদ্ধের গান কবিতা আবৃত্তি নৃত্য নাটক।
×