ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লালমনিরহাটের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক চাষীরা ফলায় ৩৩ রকমের সবজি;###; গত বছরের শীতে হরতালের কারণে পানির দামে সবজি বিক্রি করেছে তারা;###; এবার তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে

মঙ্গাপীড়িত গ্রামীণ জনপদে এখন সবজি বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

মঙ্গাপীড়িত গ্রামীণ জনপদে এখন সবজি বিপ্লব

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ শীতের সবজি শিম চাষ করে ভাগ্য ফিরিয়েছেন লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামের পর গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ের চাষীরা। শীত মৌসুম মানেই উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত জেলা লালমনিরহাটে একসময় কর্মহীন ও মঙ্গাপীড়িত মানুষের মুখোছবি ভেসে বেড়াত। এখন সেই চিত্র নেই। শীতের মৌসুমে কৃষক প্রচলিত ফসল চাষ হতে বেরিয়ে এসে অপ্রচলিত শীতের সবজি চাষে মনোযোগী হয়েছে। এতে তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকরাও ভাগ্য ফিরিয়ে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা নিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক শত শত কৃষি শ্রমিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। শীতের সবজি কিনতে তাই এখন প্রতিদিন অন্য জেলার সবজি ব্যবসায়ীরা এই জেলায় এসে পড়ে আছে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নগদ অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেয়েছে। শীতের সবজি শিম, আলু, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলাসহ প্রায় ৩৩ রকমের শীতের সবজি এই জেলায় চাষ হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বর্তমানে লালমনিরহাট জেলা শীত মৌসুমে প্রচলিত ফসল চাষের পাশাপাশি সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সবজি চাষ গ্রামীণ অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নানা শ্রমজীবী মানুষের। কৃষি শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক ও ক্ষুদ্র সবজি ব্যবসায়ী প্রতিদিন নগদ আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি শীত মৌসুমে জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় নয় শ’ পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে এক হাজার পাঁচ শ’ মেট্রিক টন, হাতীবান্ধা উপজেলায় সাত শ’ কুড়ি হেক্টর জমিতে আট হাজার ছয় শ’ মেট্রিক টন, কালীগঞ্জ উপজেলায় এক শ’ পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে ছয় শ’ মেট্রিক টন, আদিতমারী উপজেলায় এক হাজার কুড়ি হেক্টর জমিতে বারো হাজার ছয় শ’ চৌত্রিশ মেট্রিক টন ও সদর উপজেলায় দুই শ’ দশ হেক্টর জমিতে তিন শ’ একুশ মেট্রিক টন শিম চাষ আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিম চাষে অনুকূল আবহাওয়া থাকায় জেলার ৫টি উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক শিম চাষ হয়েছে। অগ্রিম শিম চাষ হওয়ায় প্রথম দফায় কৃষক শিমের বাজারে মূল্যও পেয়েছে বিগত কয়েক মৌসুমের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক একমাস আগেই শিম ক্ষেত থেকে তুলে জমিতেই বিক্রি করছেন। কালীগঞ্জের চলবলা গ্রামের কৃষক রজমান আলী (৫৫) জানান, এবারের শীত মৌসুমে শীতের সবজি নির্বিঘেœ বিক্রয় করতে পেরেছি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কোন হরতাল, আন্দোলন, পরিবহন ধর্মঘট নেই। গত বছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি তার কাছে অভিশপ্ত মাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গত বছর শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষ করে শুধু ধর্মঘট, হরতাল, গাড়িতে আগুন নানা কারণে সবজি দেশের অন্যত্র মহাজনরা নিতে পারেনি। ফলে পানির দামে সবজি বিক্রি করতে হয়েছে। অনেক সময় জমিতেই ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। জমি হতে ফসল তোলা শ্রমিকের মজুরির দামও ফসল বিক্রি করে হয়নি। এবারে শীতের সবজির দাম পেলে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। সমস্ত জেলার এক পাশে ভারতীয় প্রায় দুই শ’ পঁচিশ কিলোমিটার সীমান্ত। জেলায় তিস্তা নদী, ধরলা নদী, রতœাই নদী, সতী নদী, সানিয়াজান নদী, গিদারীযা নদীসহ ছোট বড় ৫-৭টি নদী রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি থাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। শীত মৌসুমে থাকে শুকনো। নিম্নাঞ্চলে কৃষক ধান, পাট, ভুট্টাসহ বছরে একটি ফসল আবাদ করে আসছিল বাপ-দাদার আমল হতে। তাই জেলায় খাদ্যাভাব ও কৃষি শ্রমিকের কর্মসংস্থান ছিল খুব কম। বছরের অধিকাংশ সময় এই অঞ্চলের কৃষক অন্য জেলায় কৃষি কাজ করতে যেত। এই কৃষি কাজ করতে যাওয়ার সময় তারা স্বল্প ভাড়ায় বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে ও ট্রাকে করে যেত। এখন সেই অভাবী অঞ্চল নেই উত্তরাঞ্চল। বিশেষ করে লালমনিরহাট। কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। শীতের মৌসুমে গ্রামের ফসলের মাঠগুলো একসময় (কয়েক বছর আগেও) ধূধূ শ্মশানের মতো বিরান হয়ে পড়ে থাকত। এখই শীতের মৌসুমে জমিগুলোতে সবুজে সবুজে ঘেরা। কোথাও বা শিমের কমর পর্যন্ত মাচাংয়ে সাদা, হলদে ও বেগুনি ফুল ধরে আছে আবার মাচাংজুড়ে সবুজ শিমের পাকার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায় সবুজ ও বেগুনি রঙের শিম ধরে আছে। গ্রামের পর গ্রাম বেগুন ক্ষেত। ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, পটোলের ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। এসব ফসলের মাঠে নারী-পুরুষ এক সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে কাজ করছে। এই জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় কুমড়িরহাট, চাপারহাট, চামটা, শিয়াল খাওয়া। সদরের মোগলহাট, কর্ণপুর, বানিয়াটারীতে সব চেয়ে বেশি শিম, ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ হয়। তিস্তা নদী ও ধরলা নদীর চরে আবাদ হয় প্রজেক্ট করে আলুর চাষ। কুমড়িরহাটের কৃষক ও অধ্যাপক আব্দুল কাদের জানান, একটি বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করার। পাশাপাশি নিজের বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমিতে প্রথমে শখের বসে চাষাবাদ শুরু করি। এখন সেই শখ সবজি চাষের নেশা ও পেশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর শীত মৌসুম এলেই লালশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, করলা, ঝিঙ্গা ও শিম চাষ করি কয়েক বিঘা জমিতে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে সবজি বিক্রি করে আয় হিসেবে ৪-৫ লাখ টাকা ঘরে আসে। তিনি জানান, ৬০ দিনের ফসল ফুলকপি, বাঁধাকপি। এক বিঘা জমিতে কপি আবাদ করতে খরচ হয় ১২-১৫ হাজার টাকা। কপি বিক্রি হয় প্রতিপিস কপি ৭-১০ টাকা দরে হলেও ৬০-৭০ হাজার টাকা। একই রকম শিম চাষে এক বিঘাতে খরচ হয় ৭-১০ হাজার টাকা। শিম বিঘাপ্রতি উৎপাদন হয় প্রায় ১১-১৫ মণ পর্যন্ত। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ হাজার টাকা। চলতি বছর শিমের ফলন ভাল ও বাম্পার হয়েছে। এবারে শীতের ফসলে তেমন কোন রোগবালাই দেখা যায়নি। উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটে শিল্প কলকারখানা নেই। অভাব ও কাজের সঙ্কট এক সময় প্রখর ছিল। সরকার শিল্প কলকারখানা স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যায়। সরকার যায় সরকার আসে শিল্প গড়ে ওঠে না। বরং শিল্প গড়ে তোলার কথা বলে ঋণ নিয়ে ঋণ খেলাপীর উদাহরণ অনেক আছে। কৃষক সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকেনি। তার জমিকেই একেকটি ফসল উৎপাদনের শিল্প হিসেবে গড়ে তুলেছে। কৃষি ও খাদ্যশস্য উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে লালমনিরহাটের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন শুধু সরকারের একটু পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সবজি সংরক্ষণের হিমাগার, বিপণন ব্যবস্থা সহজ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ফসল উৎপাদনে অঞ্চলভিত্তিক শস্য উৎপাদনের শ্রেণীবিভাজন করা প্রয়োজন। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মোঃ সাফায়াত হোসেন জানান, এই জেলার মাটি ও আবহাওয়া শিমসহ সবজি চাষের উপযোগী। তাই কৃষক সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েছে। প্রচলিত কৃষি ফসলের পাশাপাশি সবজি চাষ করে এই জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন।
×