ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় নিশান উড়ছে ওই!

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

বিজয় নিশান উড়ছে ওই!

উত্তম চক্রবর্তী ॥ “পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে/ জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/ এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।” দেশের শ্রেষ্ঠ কবি প্রয়াত শামসুর রাহমানের এই কবিতা ৪৩ বছর আগে একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালীর জাতীয় জীবনে। বাঙালী জাতির জীবনে আজ এক আনন্দের দিন। এমনি এক দিনের প্রতীক্ষায় কেটেছে বাঙালীর হাজারো বছর। বহু কাক্সিক্ষত সেই দিনটির দেখা মিলেছিল ইতিহাসের পাতায় রক্তিম আখরে লেখা এক সংগ্রামের শেষে ১৯৭১ সালে, ১৬ ডিসেম্বর। অন্ধকার আর কুয়াশা বিদীর্ণ করে ভোরের আলো এসে পড়েছিল বাংলার মাটিতে। সূচিত হয়েছিল নতুন একটি দিন। বিজয়ের অনন্য মহিমায়, চেতনার উদ্দীপনায় ভাস্বর দিন। আজকের এই দিন জাতিকে স্মরণ করে দিচ্ছে ৪৩ বছর আগের সেই দিনকে, যেদিন প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়েছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির অপার আনন্দ, বিজয়ের উল্লাস। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৪৩ বছর আগের এদিনে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী হাতের অস্ত্র ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বিজয়ী বীর বাঙালীর সামনে। স্বাক্ষর করেছিল পরাজয়ের সনদে। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। আজ ১৬ ডিসেম্বর; রক্তনদী পেরিয়ে আসা আনন্দ-বেদনায় মিশ্র মহান বিজয় দিবস। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে আনন্দের, গৌরবের দিন। বাঁধভাঙ্গা আনন্দের দিন। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। সেই সঙ্গে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তের দায়মুক্তির সূচনাপর্বও। পূর্বাচলে আজ উদিত যে সূর্য, প্রতিদিনের হয়েও সে প্রতিদিনের নয়; তার রক্তিমতায় তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত আমাদের মনে পড়বে; আকাশ যে কোমলতায় আজ উদ্ভাসিত, একাত্তরের সম্ভ্রমহারা দশ লাখ মা-বোন-জায়ার ক্রন্দনধোঁয়া সে উদ্ভাস। ভোরের যে রাঙা আলোটি আজ স্পর্শ করেছে ভূমি, স্বদেশের সেই পবিত্র ভূমি ভিজে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রক্তে; আর সেই রক্তস্রোতে মিশে আছে জাতীয় চার নেতার উষ্ণ শোণিত। দেনদরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগরসমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্তসাগর পেরিয়ে বাঙালী জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে। বিজয়ের তেতাল্লিশ বছর পূর্তিতে তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ! তীব্র শোষণের কুহেলী জাল ভেদ করে একাত্তরের এই দিনটিতে প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকমিকিয়ে উঠেছিল বাংলার শিশিরভেজা মাটি, অবসান হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। নয় মাসের জঠরযন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ; স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঝড়ের ভেতরে বিকশিত অটল বৃক্ষের জীবন্ত প্রতীক স্বাধীনতা নামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আজও প্রচ- ঝাঁকি দেয় রক্তে, শাণিত করে চেতনা। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪৩ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। যে সূর্য কিরণে লেগেছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রং। সেই রক্তের রং সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল লাল সবুজ পতাকা। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অর্জনে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু বিজয় অর্জনের ৪৩ বছর পরও সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। সেই সাম্যে দেশ আজও হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশ। আজও একাত্তরের পরাজিত শক্তির আস্ফালন চলছে। ছোবল মারতে চাইছে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ওপর। তবে এক অন্যরকম পরিবেশে বাঙালী জাতি এবার পালন করবে দেশের জন্মদিন। একাত্তরের মতোই দায়মুক্তির আরেকটি বিজয় যেন এসেছে বাঙালীর জীবনে। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জীবিত জাতি আজ মহান বিজয় দিবস পালন করবে এক অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে। বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখ-ের বিজয় দিবস এসেছে স্বস্তির বার্তা নিয়ে। চারদিকে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানী হায়েনার দোসরদের শত ষড়যন্ত্র চললেও আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে স্বাধীনতাকামী বাঙালী। বিজয়ের আনন্দের এই দিনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কিছুটা হলেও কমিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে দাবি তুলেছিল, তা বাস্তব রূপ দিয়েছেন তিনি। শত ষড়যন্ত্রের কুহেলিকা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে বর্তমান সরকার। অন্যান্য শীর্ষ নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীও এখন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। গোটা জাতি এখন সব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আদালতের রায় কার্যকর দেখার দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ। শেখ হাসিনার সরকারই একাত্তরের সব হন্তারককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেশকে অভিশাপমুক্ত করবে, কলুষমুক্ত হবে বাঙালী জাতি; সেটি দেখার প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। তাই এবারের বিজয় দিবস বাঙালী জাতিকে ডাক দিচ্ছে রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীমুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের। ফ্লাশব্যাক ॥ বাঙালী আঘাত খেয়েছে বার বার, আহত পাখির মতো আর্তনাদ করেনি। ভেঙ্গে পড়েনি ব্যর্থতার ক্রন্দনে। সমস্ত আঘাত সে বুক পেতে নিয়েছে, সর্বাঙ্গ রুধির মেখে অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই ১৯৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে। বহু শতাব্দীর স্বপ্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। অবর্ণনীয় দুর্যোগে ল-ভ- হওয়া বাংলাদেশের বঞ্চিত ও শোষিত মানুষ রুখে দাঁড়ায় সর্বশক্তি দিয়ে। আত্মবিস্মৃত বাঙালী আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে উৎসর্গ করে নিজ ও স্বজনকে। ছিনিয়ে আনে বিজয়, লাল সবুজ পতাকা সংবলিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। এদিনের সকালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছান সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে। সেখানে নিয়াজী নেই, ফরমান আলীকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। নিচু কণ্ঠে ফরমান আলী জানান, আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় ভারতে সেই সংবাদ পাঠাতে পারছেন না। কেলি প্রস্তাব দিলেন, জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহার করে তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেয়া সময় সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানো ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর বাকি সব প্রস্তাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পেঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল নয়টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) একটি দোতালা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। বরাবরের মতো সেদিনও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের দরজা একটু খোলা। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী অভ্যাসবশে ডান হাতের আঙ্গুল কামড়াচ্ছেন। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোনটি বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারে না। কী কথা হলো বোঝা গেল না। কিন্তু ফোন রেখে, চোখেমুখে সব পাওয়ার আনন্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেনÑ ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল চারটায় আত্মসমর্পণ।’ প্রধানমন্ত্রী নিজেই অবশ্য খবরটি সবাইকে শোনালেন। আর বললেন, কাজের প্রথম পর্যায় শেষ হলো কেবল। এবার দ্বিতীয় পর্যায় দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে সবাইকে। এদিকে ঢাকায় পাকা খবর এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ আগে। আত্মসমর্পণ হবে বিকেল সাড়ে চারটায়। ঢাকাবাসী কী করবে, আর কী করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করল। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েছে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। পৌষের এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। ঠিক যেখান থেকে জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের সাতই মার্চ বর্জ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পেঁছান ইস্টার্ন কমান্ডের যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার। দুপুর একটার পর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। একপক্ষে নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ। অপরপক্ষে জ্যাকব, নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী। সিদ্ধান্ত হয়, দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চীফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বিজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজীঅভ্যর্থনা জানান যৌথ বাহিনীর কমান্ডারকে। এরপর আসে সেই মাহেদ্রক্ষণ। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীরেসকোর্স ময়দানে এলেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও বিজিত সৈনিকরা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়। বিকেল চারটায় নিয়াজীও অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজি। দলিল আগে থেকেই তৈরি ছিল। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজির দিকে। তখন বিকেল ৪টা ২২ মিনিট। অবনত মস্তকে জেনারেল নিয়াজী দলিলে স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এ সময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। আত্মসমর্পণে স্বাক্ষরের পর রেওয়াজ অনুযায়ী অবনত মস্তকে বিধ্বস্ত পাকি জল্লাদ নিয়াজী তার কোমরে থাকা রিভলবারটি তুলে দেন জেনারেল অরোরার হাতে। দীর্ঘ নয়মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালী জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। এলো হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালী জাতি অর্জন করে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, লাল-সবুজের অহঙ্কৃত পতাকা, বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে নিজেদের গর্বিত পরিচয়। বিজয়ের মুক্তির নিশান ওড়ে বাংলার সর্বত্র। রক্তলাল পতাকায় সিঞ্চিত হয় বাঙালীর চেতনা। বাঙালী জাতি মুক্ত আবহে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকরের দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে প্রতিহত করার নতুন সংগ্রামে উদ্দীপ্ত-উজ্জীবিত হওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে আজ মঙ্গলবার বিজয়ের ৪৩ বছর পূর্তি দিবস উদযাপন করবে। আজ প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান বিজয় দিবসের সূচনা হবে। আজ সরকারী ছুটির দিন। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নামবে কৃতজ্ঞ জনতার ঢল। বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মহান ত্যাগের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ জাতি শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। দেশব্যাপী আজ সকল ভবনের শীর্ষে উড্ডীন থাকবে জাতীয় পতাকা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। কর্মসূচী ॥ যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। বিজয় দিবস উপলক্ষে হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা, ভবঘুরে কেন্দ্রসমূহে আজ পরিবেশন করা হবে উন্নতমানের খাবার। দেশের অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্যগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় বিশেষ দোয়া মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। বিকেলে বঙ্গভবনে দেশের বিশিষ্টজনদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। সশস্ত্র বাহিনী ॥ সকাল ১০টায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ-২০১৪ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কুচকাওয়াজে উপস্থিত থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ ও পরিদর্শন করবেন। প্যারেডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র‌্যাব, কারারক্ষী, বিএনসিসি, আনসার ও ভিডিপি, সম্মিলিত মহিলা দল এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা কন্টিনজেন্ট অংশগ্রহণ করবে। ৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কুচকাওয়াজে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। প্যারেডে বিভিন্ন বাহিনীর ফুটকলাম কন্টিনজেন্ট, যান্ত্রিক বহর, অশ্বারোহী দল, বিমান বাহিনীর ফ্লাই পাস্ট এবং এ্যারোবেটিক ডিসপ্লে, আর্মি এ্যাভিয়েশন ফ্লাই পাস্ট, পতাকাবাহী এবং ছত্রীসেনা অবতরণ দল ও বাদক দল প্যারেড প্রদর্শন করবে। এছাড়া বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকার সেনাবাহিনীতে ২ জনকে অনানারি ক্যাপ্টেন, ৩ জনকে অনারারি লেফটেন্যান্ট এবং নৌবাহিনীতে ১৬ জনকে অনারারি সাব-লেফেটেন্যান্ট পদ পদোন্নতিপূর্ব মোট ২১ জনকে অনানারি কমিশন প্রদান করেছে। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সেনাবাহিনী, সদরঘাট এলাকায় নৌবাহিনী এবং মিরপুর ২ নং স্টেডিয়ামে বিমানবাহিনীর বাদক দল দুপুর ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বাদ্য পরিবেশন করবে। নৌবাহিনীর নির্ধারিত জাহাজসমূহ ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা নেভাল জেটি, চট্টগ্রামের নিউমুরিং এর নেভাল জেটি, খুলনার বিআইডব্লিউটিএ রকেটঘাঁট, বাগেরহাট মংলার দিগরাজ নেভাল বার্থ এবং বরিশালের বিআইডব্লিউটিএ জেটি রকেটঘাঁট সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য বেলা ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হবে। আওয়ামী লীগ ॥ আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশের সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে এবং সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। দুপুরের আগে ঢাকা মহানগরীর সকল থানা-ওয়ার্ড থেকে একযোগে মিছিল নিয়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে সমবেতন হবেন এবং সেখানে স্থাপিত শিখা চিরন্তনে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ধানম-ির ৩২ নম্বর অভিমুখে বিজয় মিছিল করবে আওয়ামী লীগ। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি (জেপি), জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, সাম্যবাদী দল, গণফোরাম, গণতন্ত্রী পার্টি, জাকের পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ অজস্র সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পালন করছে বিস্তারিত কর্মসূচী। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দির ও উপসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে প্রার্থনা সভা। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সাক্ষাত ॥ মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) আনন্দ স্বরূপের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারত সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ৩৮ সদস্যের বীর যোদ্ধার একটি প্রতিনিধি দল সোমবার ঢাকার রেডিসন হোটেলে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। সাক্ষাতকালে তাঁরা পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময় করেন। আইএসপিআর জানায়, প্রতিনিধি দলটি মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সোমবারই বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের সঙ্গে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কর্মরত ৪ কর্মকর্তাও রয়েছেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যগণ আজ সাভার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এছাড়াও ঢাকা সেনানিবাসস্থ বিজয়কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। এছাড়া আগামী ১৮ ডিসেম্বর কাপ্তাই লেক ও নিলগিরি পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দলটির আগামী ২০ ডিসেম্বর দেশে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
×