ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরের বীরাঙ্গনা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

একাত্তরের বীরাঙ্গনা

জাফর ওয়াজেদ ॥ আলবার্তো মোরাভিয়ার ‘টু উইমেন’ উপন্যাসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন চিত্র সংক্ষুব্ধ করে পাঠককে। নির্মিত চলচ্চিত্রে মা ও মেয়েকে ধর্ষণের নির্মম দৃশ্যপটটি যে বাংলাদেশেও পুনরাবৃত্ত হবেÑ এমন ধারণা ঘুনাক্ষরেও ছিল না বাঙালী জনগণের। কিন্তু একাত্তর সালে বাংলাদেশে নারীর ওপর যে বর্বরতম নিপীড়ন ঘটেছে। ধর্ষিতা মায়ের ছিন্নভিন্ন আঁচলের নিচে যে হাহাকার, ক্রন্দন মথিত বেদনা গুমরে মরেছে, তা বর্ণনার কোন ভাষা নেই। মোরাভিয়ার বর্ণিত নির্মমতাকেও হার মানায়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তি কমিটির সশস্ত্র সদস্যদের বর্বরতা ও হিংস্রতার মাত্রা থেকে রেহাই পায়নি সাধারণ বাঙালী নারীও। ঘরের ভেতর, ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে খোলা মাঠে, সেনা ক্যাম্পে কিংবা যত্রতত্র এই ধর্ষণ এবং কখনও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাকা- চলেছে। লোকলজ্জায় অনেক ধর্ষিতা নারী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। এসব ঘটনার নামমাত্র অংশ প্রকাশ পেয়েছে। চাপা পড়ে গেছে বীভৎস সেসব ঘটনার অনেকাংশ। তেতাল্লিশ বছর পর হলেও সেসব ঘটনা উদঘাটনে অনেকেই সচেষ্ট। ভারতীয় গবেষক সলিল ত্রিপাঠী বিষয়ের গভীরে গিয়ে অনেক বীরাঙ্গনার সঙ্গে কথা বলে বিভীষিকাময় ঘটনা তুলে এনেছেন। বীরাঙ্গনারা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন যে, ‘আমরা এ দেশকে মুক্ত করেছি সম্ভ্রমের বিনিময়ে হলেও, কিন্তু আমরা কিভাবে বেঁচে আছি, সে খবর কেউ রাখে না।’ কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মোমেনা খাতুন (ছদ্মনাম) ১৯৭১ সালে ছিলেন ৩ সন্তানের জননী। বয়স তাঁর তখন ১৯ বছর। সে এবং তাঁর স্বামী যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বহন ও পারাপার করত। নৌকায় করে স্বামী তার মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের পারাপার করত। মোমেনা তাদের জন্য রান্না করত। অক্টোবরের এক ভরদুপুরে রাজাকারসমেত পাকি হানাদাররা তাঁর গ্রামে হানা দেয়। সে তাঁর সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যান। সেনারা চলে গেছে শুনে সে বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু সেনারা আবার ফিরে আসে। মোমেনা তাঁর তিন মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে লেপের নিচে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেনারা তাঁকে লেপের তলা থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে। শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি দিলে মোমেনা তাঁর জীবন বাঁচাতে আকুতি জানায়। দু’জন রাজাকার ও ১ পাকসেনা তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলে মোমেনার মা তাদের পায় ধরে কান্নাকাটি করতে থাকেন এবং মেয়েকে ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু সেনারা বন্দুক তাক করে মাকে সরিয়ে দেয়। রাজাকাররা হাঁস-মুরগি ও ছাগলগুলো এবং পাকি সেনাটি মোমেনাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তারা মোমেনার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মোমেনার স্বামী মাছের ব্যবসা করতেন। ফাঁকে নৌকায় করে প্রতিদিন ৮-১০ শরণার্থীকে পার করতেন। বিহারীরা জেলেদের মাছ ধরার জালগুলো পুড়িয়ে ফেলে। অপর ধর্ষিতা নারী দেলোয়ারা (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, এক রাতে ডজনখানেক ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধা তাঁর পিতার বাড়িতে আসেন। কিন্তু বাড়িতে তখন খাবার চালও ছিল না। ২০ বছর বয়সী দেলোয়ারা ছিলেন গর্ভবতী। পরদিন সকালে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী ক্যাম্পে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর স্বামী যোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র নদীর তীরে প্লাস্টিকে মুড়ে রেখে দিয়েছিলেন। দেলোয়ারা তাঁর শাশুড়ি ও ননদের সঙ্গে থাকতেন। এক সময় পাকিস্তানী সেনারা বাড়িতে চড়াও হয়। প্রথমে তাঁর ননদকে ধর্ষণ করে। পরে সে আত্মহত্যা করে। পরে তারা দেলোয়ারার ওপর চড়াও হয়। ধর্ষণকালেই দেলোয়ারা তাদের বাধা দেন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় ধস্তাধস্তি করেন। এ সময় তাঁর স্বামী বাড়িতে আসেন এবং হানাদারদের সঙ্গে মারদাঙ্গায় লিপ্ত হন।
×