ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বীরাঙ্গনাদের জীবনকথা

কেউ কথা রাখেনি-শেষ বয়সের সম্বল শুধুই অশ্রু

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

কেউ কথা রাখেনি-শেষ বয়সের সম্বল শুধুই অশ্রু

এমএ রকিব ও খোকন আহমেদ হীরা চলছে বিজয়ের মাস। যাঁদের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালী হয়েছে স্বাধীন, পেয়েছে নিজস্ব ভূখণ্ড- পালন করছে মহান বিজয় দিবস। সেই সব বীরাঙ্গনা নারী আজ কেমন আছেন? কেমনই বা কাটছে তাদের জীবন, সংসার? জানা মতে, এদের অনেকেই আজ অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট আর দুর্ভোগের শিকার। দীর্ঘ ৪৩ বছর পর সরকারের কাছ থেকে সম্প্রতি ‘মুক্তিযোদ্ধা’র বেসরকারী স্বীকৃতিটুকু ছাড়া আর কিছু পাননি তাঁরা। শুধু আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কেউ তাঁদের খোঁজই নেয় না। আজ তাঁদের সম্বল শুধু চোখের লোনা জল। দেশের স্বাধীনতার জন্য মূল্যবান ত্যাগ স্বীকারকারী এই বীরাঙ্গনাদের। খোঁজ নিতেই সরেজমিন যেতে হয় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার দয়ারামপুর ও হাশিমপুর গ্রামে। জগন্নাথপুর ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম তখন ছিল একেবারেই নিভৃত পল্লী। আওয়ামী লীগ সমর্থক ও স্বাধীনতাকামীদের বাস ছিল গ্রাম দুুটিতে। একাত্তরে এ দুুটি গ্রামে ঘটে যায় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন ও পাশবিক অত্যাচারের বীভৎস ঘটনা। পাক হায়েনাদের সেই ভয়াল নির্যাতনের কথা স্মরণ করে আজও আঁতকে ওঠেন দয়রামপুর গ্রামের দুলজান নেছা (৬১)। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার-আলবদরের সহায়তায় একদিন খুব ভোরে গ্রাম দুটিতে হানা দেয় পাক সেনা। এলাকার বেশিরভাগ পুরুষ এ সময় অন্যত্র আত্মগোপন করতে পারলেও বাড়িতে আটকা পড়েন নারী ও শিশুরা। হানাদাররা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে ‘মুক্তি’র (মুক্তিযোদ্ধা) সন্ধান করতে থাকে। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষের ওপর শুরু করে শারীরিক নির্যাতন ও পাশবিক অত্যাচার। হায়েনার দল কয়েক ঘণ্টা ধরে গ্রাম দুটিতে চালায় এই তা-ব। যাওয়ার সময় তারা বাড়ি-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন ওই হায়েনাদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি দুলজান নেছা। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সবকিছু ল-ভ- হয়ে যায়। বর্বর পাকবাহিনীর কয়েক জওয়ান হামলে পড়ে সেদিনের অষ্টাদশী গৃহবধূ দুলজানের ওপর। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুট হয়ে যায় তাঁর সর্বস্ব। তাদের সেই হিংস্র থাবার শারীরিক চিহ্ন ঘৃণাভরে আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। একাত্তরে সম্ভ্রম হারানো দয়ারামপুর গ্রামের এই নারীই আজকে আমাদের বীরাঙ্গনা দুলজান নেছা। সেদিন একইভাবে পাকসেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন হাশিমপুর গ্রামের এলেজান নেছাসহ (৬১) অনেক নারী। এছাড়া পৃথক ঘটনায় পাক হানাদারদের নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানির শিকার হন পার্শ্ববর্তী সদকী ইউনিয়নের মটমালিয়াট গ্রামের মোমেনা খাতুন (৬০)। তবে উল্লিখিত তিন বীরাঙ্গনা ছাড়া আর কোন নারী পাশবিক নির্যাতনের কথা স্বীকার করেননি লোকলজ্জার ভয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার বীরাঙ্গনা তিন নারী আজ দুঃসহ যন্ত্রণা আর অভাব-অনটনের মধ্যে দিনযাপন করছেন। জরাজীর্ণ তাদের বাড়িঘর। দেশের যে স্বাধীনতার জন্য তাদের খুইতে হয়েছে জীবনের সর্বস্ব। সেই স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৪৩ বছর পরও তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি কোন মূল্যায়ন। পাননি তাঁরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও ন্যূনতম সহায়তা। দুলজান নেছা ॥ পাক সেনাদের শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার দুলজান নেছা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন দয়ারামপুর গ্রামে স্বামীর বাড়িতেই ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে দয়ারামপুর গ্রামটি ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ক্ষেত্র। এ জন্যই এলাকার রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাক হানাদাররা হামলা চালায় গ্রামটিতে। তারা এ সময় ঘরে ঘরে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতে থাকে। তাদের না পেয়ে নারী-পুরুষের ওপর শুরু করে অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন। দুলজান নেছা এখন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারলেও আর্থিক অনটন, অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে অতি কষ্টে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছে তাঁর। স্বামী তেছের ম-লও যুদ্ধকালীন হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে পঙ্গুত্ব জীবনযাপনের এক পর্যায়ে মারা যান। এই বীরাঙ্গনার দুই ছেলের মধ্যে একজন মুদি দোকানের কর্মচারী ও অন্যজন ভ্যানচালক। অভাবের কারণে দুই ছেলের সংসারেই চলে টানাটানি। ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের চিকিৎসা, খাওয়া ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে ছেলেদের তেমন দৃষ্টি নেই। এলেজান নেছা ॥ প্রচ- ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেয়ে কী লাভ আমাদের? সরকার ও প্রশাসন এ পর্যন্ত আমাদের জন্য কিছুই করেনি। প্রতিবছর বিজয়ের মাস এলেই সাংবাদিকরা বাড়িতে ভিড় জামায়, বিরক্ত করে আমাদের। বার বার সেই বীভৎস ও লজ্জাকর ঘটনার বিবরণ শুনতে চায়। দিতে হয় ফটো। কিন্তু এর পরও কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমাদের দুঃখ-কষ্ট কেউ বোঝে না। মোমেনা খাতুন ॥ কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের মটমালিয়াট গ্রামের বীরাঙ্গনা মোমেনা খাতুন (৬০)। তাঁর ওপর পাক হানাদারদের পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাটি আরও করুণ ও মর্মান্তিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো বীরাঙ্গনা মোমেনা খাতুন পাকসেনাদের নির্যাতনের সেই দুঃসহ নির্যাতন ও ভয়ঙ্কর স্মৃতি বুকে ধারণ করে কোনমতে বেঁচে আছেন। টাকা-পয়সার অভাবে চোখের চিকিৎসা করাতে পারছেন না তিনি। স্বামী আব্দুল কাদেরেরও নেই কোন উপার্জন। কৃষি শ্রমিক একমাত্র ছেলের পরিবারেও টানাটানি লেগেই থাকে। আয়-উপার্জনের অন্য কোন অবলম্বন নেই এই বীরাঙ্গনার। বরিশালের বিভা রানী ॥ ‘রাজাকার নামের শকুনি থাবায় আমার মতো হাজারো নারী তাদের মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে। যে কারণে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে আমার সুখের সংসার। ৪৩ বছর ধরে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি, সেই রাজাকার মুক্ত স্বাধীন দেশ দেখে মরতে চাই। সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, দ-াদেশপ্রাপ্ত সকল যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারের যেন অনতিবিলম্বে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।’ আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেছেন, দীর্ঘ ৪৩ বছর পর্যন্ত ধামাচাঁপা পড়ে থাকা স্বাধীনতা যুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস বীরাঙ্গনা বিভা রানী মজুমদার (৬০)। সংসার হারিয়ে বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার টরকীর চর এলাকায় ভাই উপেন্দ্র নাথ ম-লের কাছে আশ্রয়ে রয়েছেন বিভা রানী। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের লালসার শিকার বিভা রানী। জীবন আর যৌবন উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। হায়েনার দল নারী জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ লুটে নিয়েছে শকুনের মতো। দেশের স্বাধীনতার সুখভোগ করার অতৃপ্ত আশা নিয়ে সে সময় সব নির্যাতন আর যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করেছেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হলেও বিভা রানীর খবর নেয়নি কেউ। গতকাল সকালে বিভা রানীর আশ্রয়স্থলে গেলে প্রথমে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। অনেক চেষ্টার পরে রোগে, শোকে ভুগে খেয়ে না খেয়ে আধমরা অবস্থায় বেঁচে থাকা বিভা রানী মুখ খোলেন। তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা মরার আগে দু’বেলা দু’মুটো ভাত আর রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই। একটি ঝুপড়ি ঘরে বসে একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠলেও অর্থের অভাবে তিনি নিজের ও পুত্রের চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
×