ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় উৎসবে জনতার ঢল;###;নতুন প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস

একাত্তরের মতই গর্জে উঠল দেশ ॥ আরেক বিজয়ের শপথ

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

একাত্তরের মতই গর্জে উঠল দেশ ॥ আরেক বিজয়ের শপথ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ নতুন রূপে ও চেতনায় এবার বিজয় দিবস পালন করল দেশবাসী। যেন একাত্তরের মতোই জেগে উঠেছিল গোটা জাতি। মাত্র এক বছর আগেই দেশের পথে-প্রান্তরে দাবি উঠেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আর মাত্র ১২ মাসের ব্যবধানেই সেই দাবি পূরণ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ায় এবারের বিজয় দিবসে কোটি মানুষের মনে ছিল প্রশান্তি আর স্বস্তির হাসি। দেশব্যাপী বিজয়ের আনন্দ-উল্লাস, আর অন্যদিকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকার শিরোমণিরা। একাত্তরের নরঘাতক কাদের মোল্লাকে আগেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে সরকার। বাকিরাও ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে, এ নিয়ে আর কোন দ্বিধা নেই দেশবাসীর। তাই মঙ্গলবার বিজয়ের তেতাল্লিশ বছর পূর্তির দিনে দেশবাসী যেন দ্বিতীয় বিজয়ের আনন্দেই ছিলেন মাতোয়ারা। সবার হাতে ছিল ফুল, আর কণ্ঠে ছিল নতুন শপথÑ‘রাজাকারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ সূচনার। আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির এমন গণজাগরণ আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের তীব্র ঘৃণা ও গণধিক্কার ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল এবারের মহান বিজয় দিবসে। বিজয়োৎসবে মাঠে নামা লাখো মানুষের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত শির আর চোখে ছিল একাত্তরের ঘাতক রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসরদের প্রতি তীব্র ঘৃণার আগুন। এসব প্রমাণ করে দেয়, সেই রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের প্রতিটি ক্ষণ; কৃতজ্ঞ জাতি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না, ভোলেনি। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর ও রাজাকারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে জাতি আরও একবার সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল- ‘রাজাকারের হয়নি সাজা, মুক্তিযুদ্ধ হয়নি শেষ/ গর্জে ওঠো বীর বাঙালি, গর্জে ওঠো বাংলাদেশ।’ সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞ বাঙালী গভীর শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছে ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতির মিনার। অনেকেই সুর মিলিয়ে বলেছে- একাত্তরের পর বিজয়ের এত আনন্দ আর নতুন প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আর দেখা যায়নি। তেতাল্লিশতম বিজয় দিবসে গোটা দেশই মেতে উঠেছিল বাঁধভাঙ্গা বিজয় উৎসবে। নেচে-গেয়ে উঠেছিল বিজয়ের আনন্দে। একাত্তরের পর বিজয়ের এত আনন্দ আর নতুন প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আর দেখা যায়নি। বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হতে রাজপথে নেমে আসা লাখ লাখ শিশু-কিশোর থেকে আবালবৃদ্ধ-বনিতার চোখে-মুখে যেমন ছিল বিজয়ের আনন্দ ঠিক তেমনি ছিল একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণা-ধিক্কার আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর ও জামায়াত নিষিদ্ধের প্রচ- দাবি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের পর রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ নিয়ে মঙ্গলবার বিজয়ের ৪তম বছর পূর্তি উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া দেশের সকল প্রান্তরে উঠেছিল গগনবিদারী একই আওয়াজ- “আর সময়ক্ষেপণ নয়, অবিলম্বে ফাঁসি চাই একাত্তরের ঘৃণ্য হন্তারক নরপশুদের।” রক্তের নদী বেয়ে আনন্দ-বেদনায় মিশ্র মহান বিজয় দিবসে আয়োজিত প্রায় সব কর্মসূচীর মূল সুর এবং কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি। তবে আনন্দমুখর এ উৎসবে বরাবরের মতো এবারও অন্তঃস্রোত বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। বিজয় দিবসের নানা আয়োজন তরুণ প্রজন্মকে দোলা দিয়েছে, স্মৃতির ঝাঁপিতে নাড়া দিয়েছে ইতিহাসের সেদিনের সাক্ষীদের। বাংলাদেশের সোঁদাগন্ধময়ী মাটির যে হৃদস্পন্দন সেখানে এই বাংলার প্রতিটি সন্তানের ভিন্ন মাত্রিক সম্পর্ক দেশপ্রেমের দর্শনকে ক্রমাগত শানিুত করেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে ওঠা রাজাকার-আলবদরমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের এই দাবি বিজয়ের দিনে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে গোটা দেশে। এভাবেই স্বস্তির পরিবেশে মুক্ত আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো লাখো জনতার বাঁধভাঙ্গা আনন্দ, উচ্ছ্বাস, মহান শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার জাতি পালন করল মহান বিজয় দিবস। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অলিগলি, পাড়া, মহল্লা, রাজপথে বিনাবাধায় দিনভর বেজেছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বর্জকঠিন ভাষণের রেকর্ড আর কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান। বাঙালী জাতি আনন্দ, বেদনা আর বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদকে, স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দিবসটির মূল অঙ্গীকারই ছিল পরাজিত অপশক্তি ও তাদের দোসরদের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখে দিয়ে জঙ্গীবাদমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে সম্মিলিতবাহিনীর দৃষ্টিনন্দন-মনোলোভা কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানমালা ছিল উল্লেখ করার মতো। দিবসটি ঘিরে আলোচনা, সেমিনার, বক্তৃতা ও যুক্তিতর্কসহ সবকিছুতেই ঘুরেফিরে প্রাধান্য পায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ার স্বস্তি, আর রায় কার্যকরের দাবি। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জঙ্গী-মৌলবাদ, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন এক জন্মভূমির স্বপ্নের কথাও ধ্বনিত হয়েছে সর্বত্র। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় চিহ্নিতÑকুখ্যাত একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীরা রক্তস্নাত পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মতো দুঃসাহস দেখালেও এবার অনেকটাই গর্তে ঢুকেছে তারা। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার শিরোমণিরা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় একবছর আগেও দেশজুড়ে পরিকল্পিত সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও তা-ব চালালেও মঙ্গলবার বিজয়ের দিবসে কোথাও সেই জামায়াত-শিবিরের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত নতুন প্রজন্মের সাহসী পথচলায় এবারের বিজয় দিবসে রাজনৈতিক বিতর্ক বা স্বাধীনতা বিরোধীদের কোন আস্ফালন ছিল না। একাত্তরের মতোই বিজয়ের আনন্দে লাখো মানুষ নেমেছিল রাজপথে। বিগত বছরের তুলনায় এবারে দ্বিগুণেরও বেশি কর্মসূচীর মাধ্যমে বিজয় দিবস পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি গভীর শোক, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মাধ্যমে বীর শহীদদের স্মরণ করে, সম্মান জানায় দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দিয়েছে ঢাকার অদূরে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। রাজধানীর বাইরে সব কটি বিভাগ ও জেলা শহরের চিত্রও ছিল প্রায় অভিন্ন। রাজধানীজুড়ে রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট, যানবাহন এবং বাসাবাড়িতে পতপত করে উড়েছে রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকা। ছোট ছোট কাগজ বা কাপড়ের তৈরি পতাকা হাতে নিয়ে বা বুকে-পিঠে লাগিয়ে শিশু-কিশোররা বেরিয়েছিল ঘরের বাইরে। কেউ কেউ মুখে এঁকেছিল লাল-সবুজ পতাকা। তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সূর্যোদয়ের সময় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মঙ্গলবার ভোরে বিজয় দিবসের কর্মসূচী শুরু হয়। ভোর থেকেই সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং ধানম-িস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে নামে জনতার ঢল, সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। অন্যদিকে রাজধানীজুড়ে বিজয় দিবস ঘিরে ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা। পথে পথে সঙ্গীত, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা এবং সব কর্মসূচীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার প্রকাশ পায়। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ছিল সরকারী ছুটি। শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করে। রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় এবং জেলা সদরের প্রধান প্রধান সড়ক, মোহনা ও উৎসব পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। বেতার-টেলিভিশনে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান এবং সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে দিবসটির মাহাত্ম্য তুলে ধরা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে হাসপাতাল, শিশুসদন, কারাগার ও এতিমখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। এছাড়া জাতির সুখ, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ মোনাজাত। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল ॥ হাতে লাল সবুজের পতাকা আর রং-বেরঙের ফুল, হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা নিয়ে আর রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ নিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। দেশের শ্রেষ্ঠ সূর্যসন্তানদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার ফুলে ফুলে ঢেকে যায় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদী। জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের জমায়েতে ছিল বুড়ো থেকে শিশু পর্যন্ত সব বয়সী মানুষ। ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। সকলের চোখে-মুখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রায় কার্যকরের দৃপ্ত শপথ। বিজয়ের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ঘিরে গোটা সাভার যেন পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। সাভার থেকে সৌমিত্র মানব জানায়, ‘সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ রুখে দাঁড়াও’, ‘স্বাধীন এই বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’, ‘বিজয় দিবসের অঙ্গিকার, রুখতে হবে জামায়াত-শিবির-রাজাকার’. ‘সফল হোক সফল হোক, বিজয় দিবস সফল হোক’- মঙ্গলবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৪৩ বছর পূর্তিতে আগত লাখো মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত এ সকল ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা। আগতদের বিনম্র শ্রদ্ধায় এদিন ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের গভীরভাবে স্মরণ করা হয়। বিজয়ের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ঘিরে গোটা সাভার যেন পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এদিন ভোরে শীতের মধ্যে কুয়াশায় ঘেরা স্মৃতিসৌধের সামনে জড়ো হয় হাজার হাজার জনতা। সকালের প্রথম প্রহরে ভোর সাড়ে ৬টার পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিন বাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল তাঁদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। এরপর তাঁরা স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, কূটনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা এবং পদস্থ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সকাল পৌনে ৭টার দিকে মহান বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ। এ সময় দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়ার আগে বেশ কিছুটা সময় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষকে। খালেদা জিয়া স্মৃতিসৌধে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সকাল সাড়ে ৯টার পর। কিন্তু তাঁকে স্বাগত জানাতে আসা নেতাকর্মীরা সকাল ৭টা থেকেই বেদীর সামনে অবস্থান নেয়। সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকে। বিভিন্নস্থান থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসহ প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসা বিএনপি কর্মীরা এ সময় নিজেদের স্থানীয় নেতার নামে সেøাগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে বেদীর সামনের পুরো স্থানই বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলে চলে গেলে বিভিন্ন সংগঠনের মানুষকে সেই ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে বেদীতে ফুল দিতে যেতে হয়। খালেদা জিয়া চলে যাওয়ার পর ফিরে যান দলীয় নেতাকর্মীরা। এতে ভিড় কমলে আগতদের ভোগান্তিও কমে যায়। এরপর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, এলডিপি (অলি), বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), জাকের পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), বিকল্প ধারা বাংলাদেশ- কেন্দ্রীয় কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনসমূহ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ- ভাসানী) কেন্দ্রীয় কমিটি, ঐক্য ন্যাপ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আরও শ্রদ্ধা জানায়- সোনার বাংলা পার্টি, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি), বিপ্লবী ছাত্র সংহতি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ শ্রমিক কংগ্রেস, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ- ঢাকা জেলা, সাভার ও আশুলিয়া, জাতীয় বিদ্যুত শ্রমিক লীগ, জাতীয়তাবাদী মহিলা দল- ঢাকা জেলা, ঢাকা জেলা বিএনপি, সাভার পৌর ছাত্রদল, সাভার পৌর জাতীয়তাবাদী হকার্স দল, স্বেচ্ছাসেবক দল- আশুলিয়া থানা, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দল- ঢাকা জেলা, গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন- কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (পিটিএটিসি), পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)- সাভার, বাংলাদেশ প্রাক্তন সৈনিক সংস্থা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হলসমূহ, বাংলাদেশ মাশরুম ফাউন্ডেশন- সাভার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার প্রেসক্লাব, আশুলিয়া প্রেসক্লাব, গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড রিসার্চ (নিটার), ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা জেলা পুলিশ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, উপাচার্য- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হলসমূহ, আরকাইভ ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, উপাচার্য- বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি, তৃণমূল গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন, কর্মজীবী নারী, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন, এডাব, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব), গণ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্য- শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আইন সমিতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমিতি, সাভার পৌরসভা, স্বাধীনতা মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমপিএ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ- সাভার, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, গণমুক্তি ইউনিয়ন, ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ, দি খ্রিস্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খ্রিস্টান এ্যাসোসিয়েশন, সড়ক ও জনপথ প্রকৌশলী সমিতি, পাহাড়ী মৈত্রী সংঘ, ডক্টরস্ এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন- ঢাকা, টিসিবি সাহিত্য সংস্কৃতি ও ক্রীড়া পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণতান্ত্রিক গার্মেন্টস শ্রমিক ফোরাম, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন- কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ইউনিয়ন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী সংঘ, জাতীয় বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, নাগরিক ঐক্য ও এর অঙ্গ সংগঠনসমূহ, অটো রিকশাচালক শ্রমিক ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্র্মূল কমিটি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, চাঁপাই-নবাবগঞ্জ জেলা সমিতি, জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ গ্রাম পুলিশ কর্মচারী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস), সাধারণ বীমা কর্মচারী ইউনিয়ন, ন্যাশনাল কংগ্রেস অব ভলান্টিয়ারস (এনসিবি), হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন, ডিবেট ফর হিউম্যানেটি (ডিএফএইচ), মানুষ (স্বেচ্ছায় রক্তদানকারী সংগঠন), ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ অজস্র সংগঠন। এছাড়াও স্মৃতিসৌধের মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নাটক, আবৃত্তি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গান পরিবেশন করে আগতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ ॥ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৩ বছর পূর্তিতে জাতীয় প্যারেড ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর দৃষ্টিনন্দন, বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা কুচকাওয়াজ ছিল দিবসের প্রধান উপভোগ্য। জাতীয় প্যারেড ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজে সালাম প্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। বাংলাদেশ টেলিভিশন জাতীয় প্যারেড ময়দান থেকে এ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে। মঙ্গলবার সকালে শেরেবাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বর্ণাঢ্য এই কুচকাওয়াজে মুক্তিযোদ্ধা কন্টিনজেন্ট, সশস্ত্র বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, বিভিন্ন শাখা এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অগ্রগতির তথ্য জানানো হয় অতিথিদের। সকাল সাড়ে ১০টায় রাষ্ট্রপতি জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং তিন বাহিনীর প্রধানরা তাঁকে স্বাগত জানান। সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের আয়োজনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, বিএনসিসি, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি, কোস্ট গার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর সদস্যরা সুসজ্জিতভাবে এই কুচকাওয়াজে অংশ নেন। রাষ্ট্রপতি সালাম গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক এবং তিন বাহিনীর প্রধানরা অভিবাদন মঞ্চে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছিলেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, মন্ত্রিসভার সদস্য, সচিব, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, বিদেশী রাষ্ট্রদূত ও বিভিন্ন মিশনের প্রধান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আনন্দ স্বরূপের নেতৃত্বে ১৭ ভারতীয় বীর যোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন এবারের কুচকাওয়াজে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কয়েক হাজার মানুষ দুই ঘণ্টাব্যাপী এই মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। অভিবাদন মঞ্চের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল প্রতিকৃতি রাখা হয়। তাঁর পাশে ছিল জাতীয় চার নেতা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির ওপরে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি। এছাড়া বাদক দলের মঞ্চের পাশে প্রদর্শন করা হয় লাল-সবুজ-পাতা দিয়ে তৈরি জাতীয় পতাকা। এবারের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অধিনায়ক ছিলেন ৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। কুচকাওয়াজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন সংযোজিত মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম, এমবিটি-২০০০ ট্যাংক, সেলফ প্রোপেল্ড গান, আর্মাড লাইট ভেইকল ও উইপন লোকেটিং রাডার এসএলসি-২, বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে নতুন সংযোজিত ডিফেন্ডার ক্লাস বোট এবং বিমানবাহিনীতে সংযোজিত সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম প্রদর্শিত হয়। এছাড়া ২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১২০ ফুট প্রস্থের প্রদর্শিত রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা সবার দৃষ্টি কাড়ে। পদাতিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের পর অত্যাধুনিক রণসাজে সজ্জিত দল রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানায়। এছাড়া ওয়ার ডগ ও সম্মিলিত অশ্বারোহী কন্টিনজেন্ট রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানায়। পরে আর্মি এভিয়েশন, নেভাল এভিয়েশন ও র‌্যাবের ফ্লাই পাস্ট অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বিমানবাহিনীর ডিসপ্লে দর্শকদের মুগ্ধ করে। বিমানবাহিনীর অংশগ্রহণে রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্লাইং সেলুট’ দেয় রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক যুদ্ধ জঙ্গী বিমান ‘মিগ-২৯’। বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান পতাকা সদৃশ্য লাল-সবুজ ধোঁয়া উড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানায়। এবারের কুচকাওয়াজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল জাতীয় পতাকাসহ প্যারাস্যুট জাম্প। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রদর্শনীও ছিল উল্লেখ করার মতো। এরপর সম্মিলিত বাদক দলের সালাম প্রদানের মধ্য দিয়ে কুচকাওয়াজ শেষ হয়। এবার মোট ৭১৬ জন বাদক দলে অংশ নেন। কুচকাওয়াজ শেষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্যারেডে অংশ নেয়া কন্টিনজেন্ট কমান্ডারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বঙ্গবন্ধু ভবনে জনতার ঢল ॥ মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে জনতার ঢল নেমেছিল রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই জনতার ঢল নামে সেখানে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা মিছিল করে ৩২ নম্বর সড়কের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মোড়ে জমায়েত হতে থাকে। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই সর্বস্তরের মানুষের ভিড়ে গোটা এলাকা কাণায়-কাণায় পূর্ণ হয়ে যায়। কেউ এসেছে মাথায় বিজয় দিবসের ব্যান্ড বেঁধে, কেউ এসেছে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকার রঙের পোশাক পরে, রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে। তাদের সবার মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল একই সেøাগান- ‘জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’, ‘মুজিবের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই’। হাজার হাজার যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের নারী-পুরুষ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের জন্য তাদের নিজ নিজ সংগঠনের ব্যানার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল ৮টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে দলীয় প্রধান হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, মন্ত্রী শাজাহান খান, ড. আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এখনও মরিয়া হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। দেশী-বিদেশী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। কিন্তু বাংলার মানুষ বিজয় দিবসে শপথ নিয়েছে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া নির্বাচন না করে, পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে না পেরে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু বাংলার মানুষ এই ষড়যন্ত্র রুখবে। অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও কার্যকর হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু ভবন ত্যাগ করার পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর এম এ আজিজ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রমের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, কৃষক লীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তর ও দক্ষিণ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, ছাত্রলীগ উত্তর ও দক্ষিণের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ঢাকা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, সচিবালয় কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ তাঁতি লীগ, বিআরটিসি শ্রমিক কর্মচারী লীগ, জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, আওয়ামী ওলামা লীগ, শেখ রাসেল শিশু সংঘ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু হারবাল চিকিৎসক পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী যুব আইনজীবী পরিষদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় যুব শ্রমিক লীগ, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদ, শেখ রাসেল স্মৃতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা যুবকমান্ড কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রভৃতি সংগঠন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায়। ফুলে ফুলে ভরে যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। বিজয় দিবসে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা ॥ মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও তাঁর সহধর্মিণী রাশিদা খানম। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিজয় দিবসের কেক কাটেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যরাও রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বঙ্গভবনের বিশাল চত্বর ঘুরে ঘুরে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং তাঁদের খোঁজ খবর নেন। আগত অতিথিদের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন তাঁরা। জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, কূটনীতিক, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনার, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, প্রবীণ রাজনীতিক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সামরিক ও বেসামরিক উর্ধতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত শিল্পী সুবির নন্দী, শাকিল জাফর, মলয় কুমার গাঙ্গুলী, চন্দনা মজুমদার এবং শ্যামা রহমান দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। শহীদ পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর মিষ্টি ॥ মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা হিসেবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফল-ফুল ও মিষ্টি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর ও উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসবাসরত পরিবারগুলোর কাছে এসব উপহার সামগ্রী নিয়ে যান। এ সময় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিটি জাতীয় ও ধর্মীয় উৎসবে তাঁদের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাঁরা মোহাম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য ৮৪ ফ্ল্যাটবিশিষ্ট একটি বহুতল বাণিজ্যিক-কাম-আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্যও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
×