ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াত নিষিদ্ধ দাবিতে সোহরাওয়ার্দীতে প্রজন্মের শপথ

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

জামায়াত নিষিদ্ধ দাবিতে সোহরাওয়ার্দীতে প্রজন্মের শপথ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকি-হানাদারদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হয়েছিল। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় লাল সবুজের ‘বাংলাদেশ’। তখন সময় ছিল বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। বিজয়ের সেই মুহূর্তকে স্থায়ী রূপ দিতে দ্বিতীয়বারের মতো সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হয় বিশ্বব্যাপী ‘আমার সোনার বাংলা’। বুকে হাত রেখে একসুরে বিশ্ব গাইল সেই কালজয়ী গান। আমার সোনার বাংলা ... লক্ষ- কণ্ঠে ধ্বনিত হলো ‘বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’। এরপরই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অক্ষুণœ রাখার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে হাত তুলে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার শপথ পাঠ করেন হাজার হাজার মানুষ। ‘বিজয় দিবস উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুপুরের আগে থেকেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-পেশা-বয়স নির্বিশেষে মানুষের ঢল নামে উদ্যানে। চারটার আগেই পুরো মাঠ লোকে লোকারণ্য। লাল সবুজের পোশাকে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল বাংলাদেশ এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুজ্জ্বল। সমস্বরে দাবি ওঠে দ্রুত জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের। সেইসঙ্গে সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করে রায় বাস্তবায়ন করার। জাতীয় সঙ্গীতে অংশ নেন দেশের বরেণ্য শিল্পীসহ বুদ্ধিজীবী, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীসহ শিশুরা। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকসহ পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অনুষ্ঠানে আসেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। যা আয়োজকদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়কে আরও শাণিত করেছে। ‘বিজয়-২০১৪। বিজয়ের সূর্যোদয়, বাংলাদেশ বিশ্বময়। কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশ অন্তরে’ এই সেøাগান নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। জাতীয় সঙ্গীত শেষে শপথবাক্য পাঠ করান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ এই গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এতে বলা হয়Ñ ‘আমরা শপথ করিতেছি যেÑ ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অনুগত থাকব। আমরা শপথ করিতেছি যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, আহত ও পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের আত্মদান ব্যর্থ হতে দেব না। ...স্বাধীনতা অর্জনের ৪৩ বছরে তাঁর মূল্যবোধ পুনর্প্রতিষ্ঠা কবর। ...মৌলবাদ সাম্প্রদায়িকতা জাতিগত বৈষম্য দূর করবো। ...’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। ...শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও শোষিত মানুষের অধিকারসহ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো।...দারিদ্র্যমুক্ত সুখী ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাব। ...আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাসহ বিশ্বকে মারণাস্ত্র মুক্ত করবো। ...বিশ্ব মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করবো। জয় বাংলা’। এর আগে ‘বিজয় দিবস উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’র প্রধান উপদেষ্টা সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘জয় বাংলা’ বলে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম কখনই বৃথা যাবে না। আজকের সমাবেশ তাই প্রমাণ করে। সবাইকে বিজয় দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা।’ শপথ বাক্য পাঠ করানো শেষ তিনি আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন। সবাইকে নিয়ে সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পর দেশ গড়ার যোগ্য উত্তরসূূরি গণজাগরণ মঞ্চ। এ মঞ্চ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাসহ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাবে। গণজাগরণ মঞ্চের বিজয় দিবস উদ্যাপন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ড. আবুল বারকাত বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি রজ্জুতে ঝুলিয়ে বিচার করলেই আমরা সন্তুষ্ট নই। অপরাধীদের পেছনের কিসিঞ্জারদের বের করতে হবে। আনতে হবে বিচারের আওতায়। এই দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানরা অনাদর অবহেলায় থাকবে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতে চলবে মুক্তিযোদ্ধার জীবন। অন্যদিকে রাজাকাররা রাজসুখে থাকবে। ঘুরে বেড়াবে আমরা তা হতে দেব না। এই দেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তিনি বলেন, আমরা চাই মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, জয় বাংলা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান। মুক্তিযুদ্ধের পর মাঝখানের একটি সময় জয় বাংলা বলতে দেয়া হতো না। বলা হতো এটি রাজনৈতিক সেøাগান। বর্তমান প্রজন্ম ফের মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন এ সেøাগান ফিরিয়ে এনেছে। আমার বিশ্বাস আর কোন সময়, কখনই এ সেøাগান হারিয়ে যাবে না। প্রজন্ম তা কোনভাবেই হারাতে দেবে না। তিনি বলেন, অনেকে বলেন নতুন প্রজন্ম নাকি ফেসবুকে আর টুইটারে পড়ে থাকে। আমি বলি তারা মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাকে ফিরিয়ে এনেছে। অনলাইনেও জয় বাংলাকে সবখানে ছড়িয়ে দিয়েছে। তিন কোটি শিশু এখন স্কুলছাত্র। তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষা দিলে বাংলাদেশকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। আমরা আশায় বুক বেঁধেছি দেশ রাজাকার মুক্ত হবে। ঘাতকদের বিচার হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্লানি দূর হবে না। বিজয় দিবস উদ্যাপন কমিটির সদস্য সচিব ডাঃ ইমরান এইচ সরকার বলেন, বিভিন্ন দেশের গণজাগরণ মঞ্চ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠনগুলো এ কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। দেশে দেশে তারাও নিজস্ব উদ্যোগে এ কর্মসূচী পালন করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চায় সকল মানুষ। তাই সব রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাব। এর আগে বেলা সোয়া একটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘আমাদের সংস্কৃতি’, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গায়ক-গায়িকাদের কণ্ঠে ‘মুক্তিযুদ্ধের গান’, ‘বিজয় আতশ সজ্জা’ ও সর্বশেষ বিজয় মঞ্চে তারকা ব্যান্ডদলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর ফ্রিডম’।
×