ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শামসুল আরেফিন খান

লাল ইশতেহার ও বাঙালীর স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

লাল ইশতেহার ও বাঙালীর স্বাধীনতা

(১৬ ডিসেম্বরের পর) রাজা সাহেব এবং খাজা সাহেবরা ব্রিটিশ বড়লাটের কাছে দরখাস্ত দিয়েছিল হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য। জিন্নাহ সাহেব তারও অত্যন্ত কঠোর প্রতিবাদ জানালেন। ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা। বললেন, গূঢ় দুরভিসন্ধি নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক পরিম-লে একটা নোংরা ভাইরাস ছড়ানো হয়েছে। ‘তবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করলেন না’। তিনি কংগ্রেসের টিকিট নিয়ে বোম্বের একটা মুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করলেন। এ সময়টায় তিনি একজন ‘সাচ্চা ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষ ছিলেন। ধর্ম বিশ্বাস ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাজনৈতিক ইস্যু করেননি ধর্মমতকে। পরবর্তী সময় সেক্যুলার মতবাদকে তিনি আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেন। তিনি মনে করতেন ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ থাকবে বিভিন্ন ধর্মমত, জাতিসত্তা এবং সঙ্কীর্ণ বিভাজনের উর্ধে। আঞ্চলিক ঐক্য পাবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’। তিনি নিজেকে প্রথমে একজন ভারতীয় ভাবতেন। তার পরে মুসলমান। ব্রিটিশ ভয় পেয়েছিল ১৮৫৭ সালে হিন্দু-মুসলিম দৃঢ় ঐক্যের ফলশ্রুতিতে সিপাহি-জনতার অনন্য বিপ্লব ঘটতে দেখে। যাকে কার্লমার্কস বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপনিবেশবাদবিরোধী যুদ্ধ এবং মুক্তচিন্তার ঐতিহাসিকরা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছিলেন। সে যুদ্ধে সুবিধাবঞ্চিত ছোট ছোট সামন্ত ভূস্বামীরাও শামিল ছিল জনতার কাতারে। সে কারণেই ঔপনিবেশিক শাসকরা হিন্দু-মুসলিম সৌভ্রাতৃত্বের মর্মমূলে কুঠারাঘাত করল এবং ছোট ভূস্বামীদের নানারকম ছাড় ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত বুনিয়াদের ওপর দাঁড় করাল। কংগ্রেস যে একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা ছিল তেমন কথা কিন্তু আমি বলছি না। আর কংগ্রেসের কুষ্টিনামা দেখলেই সেটা খোলাসা হয়ে যাবে। সিপাহি যুদ্ধের ফোসকা শুকোতে পারেনি তখনও, ১৮ শতকের শেষভাগে সম্ভবত ৮২ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন পাঁচ উদার ব্রিটিশ নাগরিকÑ ১. এলেন অক্টেভিয়ান, ২. হেনরি কটোন, ৩. আলফ্রেড ওয়েব, ৪. উইলিয়াম ওয়েডান বার্ন ও ৫. জন উইল। এরা কারা? কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য যে ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের পথ থেকে ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষকে সরিয়ে আনা তাতে কোন সংশয় নেই। অহিংসা মন্ত্রের ঋষি মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বরলিপি পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি কংগ্রেস নেতৃত্বে বাঙালী প্রবাদ পুরুষ নেতাজী সুভাষ ও বাঙালী নেতা সি আর দাশ ও এ কে ফজলুল হককে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেননি। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরামের বিপ্লবী স্রোতে ভেসে যেতে দেননি জাতিকে। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি রদ করতে আবেগপ্রবণ হননি। বড়লাটের কাছে প্রাণভিক্ষার উত্তাল গণদাবি পাশ কাটাতে নিরুদ্দেশ থেকেছেন। এসব কথা বলে তাঁর ভাবমূর্তিতে আঁচড় কাটার অনেক ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে। নিরস্ত্র অহিংস রাজনীতির পথে গান্ধী-জিন্নাহ একই সাথে হেঁটেছেন। ব্রিটিশ বাঘের পিঠ থেকে নির্বিঘেœ অবতরণ করতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কখনই বনিবনা হয়নি। কথিত আছে গান্ধী-জিন্নাহ গুজরাটের একই বংশে জন্মেছিলেন। জিন্নাহ পরিবার ছিল ধর্মান্তরিত ইসমাইলিয়া মুসলমান। জিন্নাহ অভিযোগ করেছিলেন, ‘গান্ধী হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।’ গান্ধী জিন্নাহর কথার প্রতিবাদ করেছেন। এই অভিযোগের জবাবে নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক লুইস ফিশারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘ঐঊ ওঝ টঞঞঊজখণ ডজঙঘএ. ঞঐঅঞ ওঝ অইঝটজউ. ও অগ অ গঙঝখঊগ? অ ঐওঘউট? অ ইটউউঐওঝঞ? অ ঈঐজওঝঞওঅঘ? অ ঔঊড? অ চঅজঝও? ঐঊ উঙঊঝ ঘঙঞ কঘঙড গঊ ডঐঊঘ ঐঊ ঝঅওউ ও ডঅঘঞ ঐওঘউট জটখঊৃ.ঙঘখণ অ গঅঘওঅঈ জঊঝঙজঞঝ ঞঙ ঝটঈঐ ঈঐঅজএঊঝ.’Ñ ‘তিনি যা বলেছেন তা একেবারেই ভুল কথা। আমি মুসলিম? আমি হিন্দু? আমি কী খ্রীস্টান? আমি ইহুদী? আমি কী পার্সি? তিনি বলেছেন, আমি হিন্দুরাজ চাই। একেবারে উন্মাদ মানুষ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেউ আনতে পারে না।’ ভারতের নাইটেঙ্গেল খ্যাত সরোজিনী নাইডু জিন্নাহ সাহেবকে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের অগ্রদূত বলে অভিহিত করেছিলেন। মতিলাল নেহরুর মেয়ে বিজয় লক্ষ্মী প-িত তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন। জিন্নাহ ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস-মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ঐক্যের রাখি বাঁধতে ঢের তেল-খড় পুড়িয়েছিলেন। তাঁর দূতিয়ালিতেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ লক্ষেèৗতে সংলাপ করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নতুন রূপরেখা রচনা করেছিল। সম্পাদিত হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘লাক্ষেèৗ প্যাক্ট।’ কিন্তু সকলই গরল ভেল্। একদিকে নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ, অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা। দুই বিষফোঁড়া। তারাই বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে সব উদ্যোগে বাগড়া দিয়েছিল। জিন্নাহ ১৯৩০ সালের পর থেকে মত বদলাতে শুরু করেন। ব্রিটিশ যে কত ধুরন্ধর জাতি সেটা বিখ্যাত স্পাই মি. হেমফারের ( ঐবসঢ়যবৎ) জবানবন্দী বা স্বীকারোক্তিমূলক ৫ খ-ের একটি গ্রন্থ পড়লেই কেবল জানা সম্ভব। ১৮৮৮ সালে তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত বইটি পরবর্তীকালে বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। বিশেষ মহল বইটির বিষয়বস্তুকে বানোয়াট ও গাঁজাখোরি এবং বিভ্রান্তিকর অসত্য বিবরণ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে একজন ইরাকী সামরিক অফিসার একটি টপ সিক্রেট দলিল থেকে মূল পা-ুলিপিটি উদ্ধার করায় অবিশ্বাসের ঘোর কেটে যায়। স্পাই হেমফার সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ছিলেন। তিনি বলেছেন, অটোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের লক্ষ্যে ব্রিটিশ পাঁচ হাজার চর নিযুক্ত করেছিল। স্পাই হেমফার ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি ইরাকের বসরায় একজন চতুর মাথাগরম লোককে লক্ষ্য অর্জনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য সাগরেদ বানিয়েছিলেন। নিজে সেজেছিলেন একজন কট্টর মুসলমান। তাঁর সাগরেদের নাম মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব। তিনিই শান্তির ধর্ম ইসলামকে ‘চোখের বদলে চোখ, জানের বদলা জান’ নেয়ার তত্ত্বে বিশ্বাসী প্রতিহিংসা ও জিঘাংসাপরায়ণ ওহাবী ইসলামে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। স্পাই হেমফার তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। সৌদি রাজাকে সরিয়ে মোহাম্মদ ইবনে ওহাবকে ব্রিটিশের ভাতা খাওয়া পুতুল রাজা বানানো হয়েছিল। চলমান সময়েও সিরিয়া ও ইরাকে ওহাবী সুন্নি আইসিস ইসলামের নামে হত্যা, ধর্ষণ চালিয়ে স্পাই হেমফারের জয়গান গেয়ে চলেছে। ব্রিটিশ অনুচররা ইসলামী প-িত সেজেছিলেন। কেউ দার্শনিক, কেউ অধ্যাপক, কেউ সাংবাদিক, কেউবা মোল্লা-পুরুত ও পীর-দরবেশ সেজে বিভ্রান্তিকর সব ইসলামী জ্ঞানের তুবড়ি ছুটাচ্ছিলেন। শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব- বিবাদটাকে শাণিত করার যত কারসাজি সবই তাঁরা প্রয়োগ করছিলেন। একদিন এমনি বিভ্রান্তি ছড়ানো এক জবরদস্ত আলেমের কানে দাঙ্গা বিরোধ বাধাবার ফুসমন্তর দিতে যেয়ে মি. হেমফারের আক্কেলগুড়ুম হলো। দেখলেন সেও তাঁরই মতো একজন হাই প্রোফাইল স্পাই। হেমফার লিখেছেন স্পাই সংখ্যা এক শ’ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের। ‘এই লক্ষ্যমাত্রা যেদিন অর্জিত হবে সেদিনই উপস্থিত হবে অটোমেন সাম্রাজ্যের অন্তিমকাল।’ ॥ দ্বিতীয় পর্ব ॥ ব্রিটিশ কেন চেয়েছিল অটোমেন সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে? শুধু কী তারা ইসলামী সভ্যতাকে ধ্বংস করতে ছেয়েছিল? আমার কিন্তু সেটা মনে হয় না। আসল লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের উষর মরুভূমির অন্তরে লুকিয়ে থাকা তরল সোনার বিপুল ভা-ার। ‘ইন দ্য হার্ট অব দ্য ডেজার্ট’ গ্রন্থে লেখক মাইকেল কুয়েনটিন বিষয়টির ওপর উজ্জ্বল আলোকপাত করেছেন। দক্ষিণ আরবের পাহাড়-পর্বত ও সমতল অতিক্রম করে ১৯০০ শতাব্দীর প্রথমদিকে ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা ৪.৮ কিলোমিটার অভ্যন্তরে বেদুইন বর্বরদের আস্তানায় ঢুকে প্রথমে কয়লার সন্ধান পেল। তারও অনেক পরে তেল। অটোমেন সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২০ থেকে দুর্বার দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে ১৯৩২ সালে তেলের দেখা মিলল। ৩১ মে ১৯৩২ বাহরাইন দ্বীপের আওয়ালি নামের জায়গাটাতে তেলসুন্দরীর কেশ স্পর্শ করেছিল ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদরা। পরবর্তী বছরগুলোতে সৌদি আরব, কুয়েত এবং কাতারের কণ্টকিত বাসরে অসূর‌্যম্পশ্যা তেল রমণীকুলের সতীচ্ছেদ ঘটল। তারপর থেকেই মধুচন্দ্রিমা চলছে তো চলছেই। যেখানে ব্যত্যয় সেখানেই বোমা নানা ছলাকলায়। ষাটের দশকে প্রেসিডেন্ট কেনেডি কমিউনিস্ট দমনে সারাবিশ্বে পিস কোরের ছদ্মবেশে তিন লাখের মতো বিদ্বান বিজ্ঞ সুশীল স্পাই ছেড়ে দেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট রিগান ’৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘাতক মিখাইল গর্বাচেভের হাতে তামাক সেবন করেন। ভারতবর্ষেও তারা ক্রিয়াশীল ছিল। পাকিস্তানের সামরিক- বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে ছিল তাদের সক্রিয় অনুপ্রবেশ। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষায় ছাত্র শিক্ষক রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাদের অদৃশ্য উপস্থিতিতে সচেতন মানুষ বিশেষ করে সাংবাদিকদের নজর এড়াতে পারেনি। ১৯৬০ সালের শেষে অথবা ’৬১ সালের প্রথমদিকে কবি, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ এক ছদ্মবেশী মার্কিন স্পাই, নওমুসলিম, জনৈক প্রবাসী সিলেটির পোষ্যপুত্র, নুরুল ইসলাম তথা রবার্ট ক্রুকের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। জনপ্রিয় কাগজ দৈনিক পূর্বদেশে ছবিসহ চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল। আমার এমনই কপাল যে, সেই রবার্ট ক্রুক ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত আইএ ও বিএ ক্লাসে আমার সহপাঠী ছিল। পোশাক ছিল হাতেধোয়া ইস্ত্রি না করা সাদা ফুলশার্ট ও পাজামা। পায়ে স্যান্ডেল। পাঁচবার সালাত আদায় করা এবং পবিত্র কোরান পাঠে কখনও অনিয়ম হতে দেখা যায়নি। ঢাকা কলেজ নর্থ হোস্টেলে কিছুদিন আমরা পাশাপাশি থেকেছি। (চলবে)
×