ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ইতিহাসে উজ্জ্বল দিন

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

ইতিহাসে উজ্জ্বল দিন

উনিশ শ’ একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে কোন একদিন নিজ বাড়ির আঙিনার পাশে পায়ে চলা পথে সদলবলে যাচ্ছেন এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। করাচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা তরুণ সহপাঠী বিয়ে করে গ্রামে ফিরেছেন সম্ভবত জানুয়ারি কি ফেব্রুয়ারিতে। তখন জানতেন না কি উত্তাল সময় সামনে নিয়ে গ্রামে এসেছেন তিনি। মার্চে যুদ্ধ শুরু হলে সব দোটানা ঝেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। নববধূ, মা, বাবা, ভাইবোন কেউ আটকাতে পারেনি তাকে। কোন এক এ্যাকশন শেষে যেদিন কমান্ডার বেশে বাড়ির আঙিনা পেরুচ্ছিলেন, মা ছুটে এসে অনুনয় করে একটুখানি বসে যেতে বলেছিলেন। হাতে ধরে এমন কি মা হয়ে ছেলের পা দু’খানাও জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা একটু পানি খেয়ে যা, বৌমার সঙ্গে দুটো কথা বলে যা।’ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মাকে প্রত্যাখ্যান করে আরও দ্রুত পা চালিয়েছিলেন। সম্ভবত মন দুর্বল হওয়ার আশঙ্কায়। ক’মাস পর বিজয়ীর বেশে সদলবলে ফিরলে মায়ের বাঁধভাঙা আনন্দাশ্রু আর মুক্তিযোদ্ধাদের আকাশ ফাটানো উচ্ছ্বাসে যে আবহ তৈরি হয়েছিল তাই যে আমাদের স্বাধীন হওয়ার দুর্লভ মুহূর্ত, সেদিনের শিশুর তা বোঝার কথা নয়। সে কথা বুঝেছে সে বড় হয়ে। আরও বুঝেছে, বিজয়ের দৃশ্য সবার জন্য এমন আনন্দময় ছিল না। অনেক মায়ের সন্তান ফেরেননি। অনেককে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে মেরে ফেলে। স্বামী-সন্তানের প্রতীক্ষায় থেকেছেন হাজার হাজার নারী। অবর্ণনীয় বর্বরতার শিকার হয়েছেন দেহমনে যন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে ধিক্কৃত হয়েছেন সমাজে। আর এসবই হয়েছিল এ দেশেরই কিছু দালালের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। যাদের নৃশংসতার তুলনা হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী। ॥ দুই ॥ রাষ্ট্রের বয়স একুশ। সবই বড় হতে হতে জানা। ততদিনে শোনা গেল, এক মুক্তিযোদ্ধার মা মাঠে নেমেছেন নতুন যুদ্ধ নিয়ে। তার টগবগে তরুণ সন্তান যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। হাজার হাজার শহীদের মায়ের প্রতীক হয়ে তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করলেন। একুশ বছর পর দেশ যেন আবার জেগে উঠল। আবার আন্দোলন। আলোচনা। সভা-সেমিনার। অতঃপর বিরানব্বইয়ের ছাব্বিশে মার্চ গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায়। সে আরেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এ ঘটনার একুশ বছর পর প্রতীকী নয়, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সত্যিই এক ঘাতক দালাল রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষণা করল। এখানেই বাংলাদেশ, এ দেশের মানুষ অনন্য। তারা বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বাধ্য করেছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে। এ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম ইস্যু করেছিল যুদ্ধাপরাধী বিচার। নানা সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সরকার বিচারের রায় ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করে। দু’হাজার তেরোর বাইশ জানুয়ারি তাই এ দেশের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের উদ্যোগে ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল। সেখানে মার্কিন সেনাদের নৃশংসতার নানা দিক সম্পর্কে বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধীদের সাজা দেয়া যায়নি। প্রতীকী সাজা হওয়ার একুশ বছর পর হলেও বাংলাদেশ তা পেরেছে এবং কুখ্যাত এক রাজাকারের ফাঁসির রায় কার্যকরও করেছে। ॥ তিন ॥ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবদান রাখার জন্য আজও সম্মান ও ভালবাসার সঙ্গে উচ্চারিত হয় জর্জ হ্যারিসনের নাম। দু’হাজার চৌদ্দতে জানা গেল, হ্যারিসন সাহেবের উস্কখুস্ক চুলদাড়ি এবং গিটার বাজিয়ে গলা ফাটিয়ে গান গাওয়া বরদাশ্ত করেননি বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞজনেরা। তাই তিনি বাদ পড়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম থেকে। অবশ্য অপরাধের শিকড় থাকতে পারে অন্যখানেও। তিনি তৌহিদী বলয়ের বাইরের লোক ছিলেন, সুতরাং ইমান আকিদা কলুষমুক্ত রাখতে তাঁর ছবি বাদ দেয়া যেতেই পারে। একই কারণে রবীন্দ্রনাথও এক সময় বাতিল হয়ে যাচ্ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ হলেও পূর্ব পাকিস্তানী সংস্কৃতির কেউ নন। তিনি ‘হিন্দু’ এবং ‘ভারতীয়’ সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে বর্জনীয়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ আরও অনেকেই বাতিল হন। অর্থাৎ রবীন্দ্রবিরোধিতার ছলে ওই তত্ত্ববাগীশরা আসলে চেয়েছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পঙ্গু করে দিতে। ষাট দশকে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রবিরোধী আন্দোলন ছিল আসলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চা বিরোধী আন্দোলন। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন দেশে তেতাল্লিশ বছর পর মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগী হতে পাঠ্যবই থেকে বিদায় নিতে হয় জ্ঞানদাশ, লালন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিপ্রদাশ বড়ুয়াকে। তাঁদের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হন ফররুখ আহমদ, মুহাম্মদ সগীর, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। ‘মংডুর পথে’ হয়ে যায় ‘মদিনার পথে।’ ‘তৈল চিত্রের ভূত’ ‘তৈল চিত্রের আছর’ হতে হতে অল্পের জন্য রক্ষা পায়। কোথাও কি ফেলে আসা পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে? ॥ চার ॥ বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, যুদ্ধাপরাধ অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে দেড় শ’ বছর আগে। আমাদের এখানে বিচার হচ্ছে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আদলে। এ ধরনের ট্রায়াল নুরেমবার্গেই প্রথম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় উনিশ শ’ পঁয়তাল্লিশ সালে। এর পরপরই নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে বিজয়ী দেশগুলো। ওই আদালতে চব্বিশ জনের বিচার হয়েছিল। নুরেমবার্গের পর উনিশ শ’ ষাট সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দশ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। জাপানেও হয়েছিল। এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। কিছুদিন আগে কম্বোডিয়ায় নারীর ওপর সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের শুনানি হলো। সেখানে এখনও বিচার কাজ চলছে। এছাড়া যুগোসøাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওন প্রভৃতি দেশেও যুদ্ধাপরাধী বিচার চলছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিচ্ছিন্নভাবে শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে না। আন্তর্জাতিকভাবে সারাবিশ্বেই এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। একটা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ সেই প্রক্রিয়ার অংশ হয়েছে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সমালোচনার মুখে পড়েছে। ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক কূটকৌশলের শিকার হয়েছে। তবু নানামুখী বাধা ডিঙ্গিয়ে শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক পথেই হাঁটছে। আমাদের ট্রাইব্যুনালে অপরাধীর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ অন্যান্য দেশের ট্রাইব্যুনালের চেয়ে অনেক বেশি। দেশীয় আইন এবং বিচার কাঠামোয় বিচার হওয়ায় উচ্চ আদালতে আপীল করারও সুযোগ আছে। অন্য সব দেশে বিচার চলছে আন্তর্জাতিক আইনে। সেখানে অপরাধীর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ কম। এত সব সুযোগ থাকার পরও ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বার বার কথা উঠেছে। সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। এ সরকার ভিনগ্রহ থেকে আসেনি। একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে এসব দোষত্রুটি এড়ানো সম্ভব নয় এবং একচল্লিশ বছরে এ দেশের শাসন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা পর্যালেচনা করলে দেখা যাবে, একুশ জানুয়ারি এ দেশে যে ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা এ সরকার ছাড়া অন্য কোন সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর জাহানারা ইমাম? তিনি তো মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারাদের নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকবেন চিরদিন। জাতীয় জীবনের এতবড় কর্তব্যের প্রসঙ্গ তিনিই প্রথম তুলেছেন। ব্যক্তিগত দুঃখকে সমষ্টির মধ্যে সংক্রমিত করেছেন। তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাগুলো দিয়ে শেষ করছিÑ তবে তাই হোক। হৃদয়কে পাথর করে বুকের গহীনে বহন করা বেদনাকে সংহত করে দুঃখের নিবিড় অতলে ডুব দিয়ে তুলে আনি বিন্দু বিন্দু মুক্তো দানার মতো অভিজ্ঞতার নির্যাস। ‘আবার আমরা ফিরে তাকাই আমাদের চরম শোক ও পরম গৌরবে ম-িত মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর দিকে। এক মুক্তিযোদ্ধার মাতা, এক সংগ্রামী দেশপ্রেমিকের স্ত্রী, এক দৃঢ়চেতা বাঙালী নারী আমাদের সবার হয়ে সম্পাদন করেছেন এই কাজ। বুকচেরা আর্তনাদ নয়, শোকবিহ্বল ফড়িয়াদ নয়। তিনি গোলাপ কুঁড়ির মতো মেলে ধরেছেন আপন করে নিভৃততম দুঃখ অনুভূতি। তাঁর ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তাঁর আপনজনের গৌরবগাথা যুক্ত হয়ে যায় জাতির হাজারো বীরগাথার সঙ্গে।
×