ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মির শাহ আলম

মুক্তিযুদ্ধে শিশু

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধে শিশু

আজকের শিশুদের প্রকৃত আনন্দ হলো স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সকল অধিকার নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক, তারা বিজয় সমাবেশে অংশগ্রহণ করে, ভাষা দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়, কিন্তু লাল সবুজের পতাকা উত্তোলিত এই মানচিত্র অর্জনের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শিশুরা এবং নারী ও বৃদ্ধ মানুষ। স্বাধিকার আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতিতে সংঘটিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর পশ্চিমা শাসকদের ভাষার ও কথা বলার অধিকার হরণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা এ অঞ্চলের বাঙালীদের মুক্তির জন্য আন্দোলনমুখর করে তোলে। মূলত আমাদের আন্দোলন তখন থেকে শুরু হয়। তবে আমি মূলত ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের শিশুদের অবস্থা নিয়ে কথা বলব। আমার বয়স তখন নয় বছর। তৃতীয় শ্রেণী অতিক্রম করেছি, এ অবস্থায় তখন আমিও শিশু কিন্তু আমার পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিআন্দোলন, মিছিল সমাবেশের কথা মনে আছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ দেশ ক্রেক ডাউন হয়ে গেল। দেশ তখন বিচ্ছিন্ন। বাবা সরকারী কাজে পরিদর্শনে ২৪ তারিখে কুলাউড়া অবস্থান করছিলেন। ক্রেক ডাউন হয়ে যাওয়াতে বাবাকে হেঁটেই কুলাউড়া থেকে আখাউড়া আসতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে সামান্য রিক্সা ছাড়া অন্য কোন সাহায্য পাননি। ২৫ তারিখ রাতে বাবা আখাউড়া পৌঁছেন। ২৬ মার্চ মা এবং আমাকে নিয়ে বাবা আখাউড়া থেকে খরমপুর, দুর্গাপুর, চাঁনপুর হয়ে ভারতের বর্ডারে অবস্থান করেন। ২ দিন পর ভারতের আগরতলা নরসিংগর ক্যাম্পে বাবা চলে আসেন। আমাদের এখানে রেখেই বাবা মুক্তিযুদ্ধে যান। ৩ মাস পর এলাকাসি সীমান্ত নিকটবর্তী হওয়ায় আমাদের ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ আগরতলায় উলঙ্গনগর ক্যাম্পে স্থানান্তর করেন। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম। নবেম্বর মাসের কোন এক সময় হানাদার বাহিনীর মর্টারের আঘাতে আমাদের পার্শ্ববর্তী বাঙ্কারে আনসার আলী চাচা পরিবারের সবাইকে নিয়ে মারা যান। আমাদের বাঙ্কারে একটি শেলের কণা আঘাত হানে আমার পায়ে, আমি মারাত্মক আহত হই। ঐ সময়টাতে বর্ডার অঞ্চলে প্রচ- গোলাগুলি হয়। মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা সবকিছু মোকাবেলা করেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। বিজয়ের বেশে আমরা দেশে প্রবেশ করি। মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিশু হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা আছে। শিশুরা ঐ সময়ে অনেক অসুবিধার মধ্যে পরিবারসহ বা পরিবার ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেছে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে অনেক শিশু মারা গেছে, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, আমার পাশের বাঙ্কারে দুই পুরুষ, দুই মহিলা ও তিন শিশু একই সঙ্গে মারা গেছে। আমরা যখন দেশ ত্যাগ করি সবার সঙ্গেই কিছু না কিছু মালপত্র ছিল, ফলে শিশুদের হেঁটেই সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়েছে। শিশুদের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল না, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ছিল না, অসুখ বিসুখের পর্যাপ্ত ওষুধ ছিল না, অপুষ্টি অনাহারে অনেক শিশু মারা গেছে, অনেক শিশু যুদ্ধাহত হয়েছে। দেশের ভেতরে শিশুরা ছিল অবরুদ্ধ, তাদের চলাফেরার কোন সুযোগ ছিল না। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশের ভেতরের শিশুরা সকল মৌলিক অধিকার বঞ্চিত ছিল। অনেকে ছিল নির্যাতিত। তাদের কোন লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল না, দেশী ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। শিশুদের ওপরে হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনের কোন বিচার ছিল না। শরণার্থী শিবিরেও শিশুরা খুব মানবেতর ও অবহেলিত জীবন যাপন করত। আমি যুদ্ধাহত শিশু হিসেবে অনুভব করেছি উন্নত চিকিৎসা নাগালের বাইরে ছিল। যুদ্ধকালীন অনেক শিশুও বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের পানি সংগ্রহ, খাবার সংগ্রহ, তথ্যাদি সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে শিশুরা সহযোগিতা করেছে। শিশুরা আহত নিহত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফেরার পর এক বছর তাদের ছাত্র জীবন ঝরে পড়েছে। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত বিকলাঙ্গ শিশুরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে নাই। সবাই সম্পূর্ণ সহযোগিতাও পায় নাই। আন্তর্জাতিক পরাশক্তি ও পাক হানাদার বাহিনী এ দেশে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে, এদেশকে সম্পূর্ণ মেধাহীন করার যে অপচেষ্টা করেছে তার প্রধানতম টার্গেট ছিল শিশু ও নারী। আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এ দেশের মেধাবী শিশুরা, এই প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারলে, পঙ্গু হলে, অঙ্গহীন হলে জাতির কাঁধে যে বোঝা সৃষ্টি হবে তা বুঝতে পেরে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসররা শিশু ও নারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পরিকল্পিতভাবে তারা শিশু হত্যা করেছে, শিশুরা যেন পড়াশোনা করতে না পারে সেজন্য বিদ্যালয় ধ্বংস করেছে, শিশুদের চিকিৎসা ব্যাহত করার জন্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল ধ্বংস করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদার বাহিনী এ দেশে সংঘটিত করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আমরা কম সহযোগিতা পেয়েছি। পরাশক্তির একটি অংশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় অত্যাচার নির্যাতনের পরিমাণ ছিল ভয়াবহ। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহস ও বীরত্বের কারণে আমরা বিজয়ী হয়েছি। যে শিশু যুদ্ধ পূর্বে মিছিল সেøøাগান শুনেছে রণাঙ্গনে যুদ্ধ দেখেছে বিজয়ের পর স্বাধীন দেশে ফিরেছে তার অনুভূতি এবং গৌরব ভিন্ন মাত্রার আমি সেই গৌরবান্বিত একজন শিশু। এ প্রজন্মের শিশুদের জন্য আমার আকুতি, অনেক কষ্টার্জিত আমাদের স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকা সংবলিত মানচিত্রÑ বাংলাদেশ। এটা রক্ষার জন্য আমাদেরকে একযোগে কাজ করতে হবে। দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ভোগ নয়, দেশ গঠনের আত্মনিয়োগের শপথ করতে হবে। একটি শিক্ষিত, সভ্য, উন্নত জাতি গঠনে নিজেকে অগ্রসৈনিক হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই যুদ্ধকালীন শিশুদের সকল যাতনা হ্রাস পাবে। আমরা হব সুখী সমৃদ্ধ এবং উন্নত দেশের নাগরিক। তবেই আসবে সফলতা। লেখক : পরিচালক (শিক্ষা) জাতীয় সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ
×