ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ড্রোন হামলার পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ড্রোন হামলার পরিকল্পনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানুষবিহীন ড্রোন বা কোয়াড হেলিকপ্টার দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যক্তির ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিল জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ড্রোন দিয়ে ২৫ থেকে ৩০ তলা উঁচু ভবনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। কোয়াড হেলিকপ্টারের আদলে কাঠ দিয়ে তৈরি কোয়াড হেলিকপ্টারের একটি রেপ্লিকা, ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও উগ্র মতবাদ সংবলিত বইপত্রসহ জঙ্গী সংগঠনটির দুই সদস্য গ্রেফতারের পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গ্রেফতারকৃতদের ৫ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন শহীদ ফারুক হোসেন সড়ক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালায় ডিবির দক্ষিণ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী আমিনুল ইসলাম। অভিযানে কাঠের তৈরি কোয়াড হেলিকপ্টারের আদলে তৈরি একটি রেপ্লিকা, ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম, বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও উগ্র মতবাদ সংবলিত বইপত্র উদ্ধার হয়। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার করা হয় তানজিল হোসেন বাবু (২৬), পিতা মোজাফফর লস্কর। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের মুরসিপাড়ায়। অপরজন মোঃ গোলাম মাওলা মোহনের (২৫) পিতার নাম গোলাম কাদের। বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানাধীন বৈদ্যেরখিল গ্রামে। ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে ১০ দিনের করে রিমান্ডের আবেদন করে ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। আদালত প্রত্যেককে ৫ দিনের করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেলেও তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। ডিবির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ৫০ লাখ টাকার ব্যয় ধরেছিল গ্রেফতারকৃতরা। এসব টাকার যোগান আসার কথা ছিল সংগঠনটির সদস্য ও দাতাদের কাছ থেকে। তারা কয়েকজন দাতার নামও প্রকাশ করেছে। বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কে বলেন ডিএমপির মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান এবং অভিযান পরিচালনকারী ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম জানান, ২০১০ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক প্রযুক্তিবিদ ধরা পড়েছিলেন। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান। ওই সময় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আলোচনায় না থাকায় তার বিষয়টি সেভাবে তেমন গুরুত্ব পায়নি। সদ্য গ্রেফতারকৃত দুইজন মাত্র ৬ মাস আগ থেকে ড্রোন বানানোর কাজটি করছিল। তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গী সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা জসীম উদ্দিন রাহমানীর অনুসারী। তার অনুসারী হিসেবে তারা জিহাদী কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টার করছিলেন। এদের মধ্যে বাবু নবম শ্রেণী পাস। কিন্তু প্রযুক্তিবিদ্যায় খুবই পারদর্শী। অপরজন বেসরকারী গ্রীন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্স বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। তাদের সঙ্গে পলাতক থাকা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মূলত নেতাদের নির্দেশেই তারা ড্রোন তৈরির চেষ্টা করছিলেন। ড্রোন তৈরির দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁরা। ড্রোন তৈরির প্রধান কারণ, গ্রেফতার এড়িয়ে বহুতল ভবন ও বিশেষ ব্যক্তির ওপর হামলা চালানো। ড্রোনের মাধ্যমে হামলা চালাতে হামলাকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে না। এ জন্যই তারা এমন প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটান। তারা ২৫ থেকে ৩০ তলা উঁচু ভবনে বা সেই উচ্চতার কোন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতেই ড্রোন তৈরির কাজ চলছিল। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে তারা ভূমি থেকে ভূমিতে আক্রমণ কষ্টসাধ্য। এজন্য তারা ড্রোন তৈরি করছিল। ২৫/৩০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহনে সক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন তৈরির কাজ করছিল তারা। প্রসঙ্গত, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালে হিযবুত তাহরীর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই তারা দেশী-বিদেশী জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি সরকারের কাছে তথ্য থাকলেও তারা সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেনি। এমনকি তাদের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়নি। ৫১টি দেশে সংগঠনটি নিষিদ্ধ। ২০০৮ সালে পাকিস্তান সরকার সেদেশে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। বর্তমানে পৃথিবীর ৫৩টি দেশে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ। ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলের অনেক সদস্য নতুনভাবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হয়ে সংগঠিত হতে থাকেন। হিযবুত তাহরীরের সদস্যরাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। সম্প্রতি দলটির অনেক সদস্য জেএমবি ও হুজির সঙ্গে কাজ করছে। জেএমবি বাংলাদেশের সুন্দরবনে, জামালপুরে তাদের নিজেদের তৈরি রকেটলঞ্চার পরীক্ষা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের আগে কলকাতায় জেএমবি রকেটলঞ্চারের পরীক্ষা চালিয়েছে। জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কারণে তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টা করছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা। তারই ধারাবাহিকতায় গ্রেফতারকৃতরা ড্রোন তৈরির চেষ্টা করছিল। হামলার টার্গেটের বিষয়ে তিনি বলেন, হামলার টার্গেট নির্ধারণ করার দায়িত্ব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাদের। তাদের দেয়া তালিকা মোতাবেক হামলার পরিকল্পনা ছিল। তবে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে হামলার টার্গেটে থাকা কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা ব্যক্তির নাম বা তালিকা পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারকৃতরা এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি।
×