ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নানিয়ারচরের ঘটনায় ইউপিডিএফের উস্কানি ॥ দুটি সড়কে অবরোধ চলছে

আধিপত্যের লড়াইয়ে ফের অশান্ত পাহাড়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

আধিপত্যের লড়াইয়ে ফের অশান্ত পাহাড়

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী/ জীতেন বড়ুয়া ॥ রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে গত সোম ও মঙ্গলবার পর পর দুই দিনের সহিংসতার ঘটনার নেপথ্যে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও শান্তিচুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলসের ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) শক্তির মহড়া প্রদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বুধবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ত্রাণসামগ্রী পাহাড়ী-বাঙালী কেউ গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর ও লুটের ঘটনার সত্যতা মেলেনি। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি-নানিয়ারচর সড়কে ডাকা অবরোধ বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো অব্যাহত ছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজমান। উল্লেখ্য, সোমবার রাতে পাঁচ বাঙালীর মালিকানায় দশ একর জমির আনারস এবং মূল্যবান সেগুন ও গামারী গাছের বাগান কেটে ধ্বংস করে দেয়ার পর দিন মঙ্গলবার উত্তেজিত বাঙালীরা এলাকার তিন পাহাড়ী অধ্যুষিত পাড়ার বসতবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়। পরিসংখ্যান শেষে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮। তন্মধ্যে ৬১টি বসতবাড়ি ও ৭টি দোকান ঘর। দোকান ঘরের মধ্যে ৩টি বাঙালী মালিকানার। বাড়িঘর হারানো পাহাড়ীরা নিজ নিজ এলাকার আত্মীয়স্বজনদের মাঝে আশ্রয় নিয়েছে। উত্তেজিত বাঙালীরা রয়েছে ক্ষুব্ধ অবস্থায়। এদিকে নানিয়ারচরের এ ঘটনায় পাহাড়জুড়ে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রশাসন কিছুটা বিব্রত অবস্থায় রয়েছে। জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে ঘটনার পর পরই দাবি করা হয়েছে, বাঙালীদের মালিকানার বাগান ধ্বংস করার কাজে ইউপিডিএফ জড়িত থেকে উস্কানি দিতে তৎপর হয়েছে। পাশাপাশি বাঙালীদের পক্ষ থেকেও এ ঘটনা ইউপিডিএফের কাজ বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে এখনও এ ঘটনা কারা করেছে, তা বলা না হলেও তারা নিশ্চিত ইউপিডিএফের দুর্বৃত্তরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ইউপিডিএফ বর্তমানে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। তারা একদিকে যেমন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিবিরোধী, তেমনি শান্তিচুক্তির চরম বিপক্ষে। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর থেকেই প্রসিত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ জনসংহতি সমিতির কর্মকা-ের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছে। জনসংহতি সমিতি তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণহানি, অপহরণ, গুমসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। প্রসঙ্গত, নানিয়ারচর উপজেলায় মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এর মধ্যে বাঙালীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। স্থানীয় বুড়িঘাট এলাকাটি বাঙালী অধ্যুষিত। অতীতেও নানিয়ারচরে ইউপিডিএফ বিভিন্ন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। শান্তিচুক্তির পর অশান্ত পাহাড়ে শান্তি, পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে সম্প্রীতি আসতে শুরু করার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময়ে হিংসাত্মক নানা তৎপরতা পাহাড়কে আবার উত্তপ্ত করে তুলছে। পাহাড়ের সর্বত্র আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ সব সময় মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এদের হানাহানির কারণে প্রতিনিয়ত ঝরছে তরতাজা প্রাণ। শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে ভূমির মালিকানা নিয়ে সমস্যাটি প্রকট রূপ নিয়ে আছে, যা গত সতের বছরেও সমাধান হয়নি। এছাড়া অন্যান্য চুক্তির ধারা এখনও অবাস্তবায়িত। এ বিষয়টিকে উপেক্ষা করে ইউপিডিএফ অস্ত্র হাতে জনসংহতি ও বাঙালীদের বিরুদ্ধে হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছে। বর্তমানে জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী হিসেবে মাঠে রয়েছে এক সময়ের সন্তু লারমার ডানহাত হিসেবে চিহ্নিত রূপায়ন দেওয়ান গ্রুপ। ফলে সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি নিজ সম্প্রদায়ের দ্বিমুখী আক্রমণের শিকার হয়ে আছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন ফেডারেশন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা গ্রুপ), বাঙালী ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ, পার্বত্য গণপরিষদ, পার্বত্য ভূমি রক্ষা আন্দোলন, সমঅধিকার আন্দোলন কর্মীরা সক্রিয় রয়েছে মাঠে। সর্বশেষ গত ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে জনসংহতি সমিতি প্রধান সন্তু লারমা আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ সময় তিনি শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত খিসা আদিবাসীদের অধিকারের বিরুদ্ধে, শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে। পক্ষান্তরে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে বহু বাঙালী শান্তিচুক্তির পক্ষে। এদিকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত পনের দিনের ব্যবধানে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে হত্যা, অপহরণ, গুলিবিনিময়, অগ্নিসংযোগ ও লুটের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর রাতে নানিয়ারচরের বগাছড়ি এলাকায় বাঙালীদের সৃজিত বাগান ধ্বংস করার ঘটনা ঘটে। প্রতিবাদে বাঙালীরা জ্বালিয়ে দেয় পাহাড়ীদের ৬১টি বসতবাড়ি ও দোকানঘর। একই দিন খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে স্কুলশিক্ষক চিং সাহমংকে হত্যা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের আশুতোষ ত্রিপুরার ওপর গুলি, পানছড়িতে কৃষক দম্পতি রমজান আলী ও আনোয়ারা বেগমকে ধারালো অস্ত্রে জখম করার ঘটনা এলাকাজুড়ে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শান্তিচুক্তির পর শুধু খাগড়াছড়িতেই চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে সহিংসতায় খুন হয়েছে সহস্রাধিক। যার মধ্যে ৩শ’ নিরাপরাধ বাঙালীও রয়েছে। এছাড়া অপহরণ হয়েছে দেড় শতাধিক। উল্লেখ্য, নানিয়ারচর এলাকায় ইউপিডিএফ তাদের প্রথম শক্তি প্রদর্শন করে ১৯৯৮ সালে সন্তু লারমার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালিয়ে। এরপর ২০০১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নানিয়ারচরের গুনিয়াপাড়া থেকে তিন বিদেশীকে অপহরণ করা হয়। এর আগে ১৯৯৩ সালের ১৭ নবেম্বর নানিয়ারচর বাজারে পাহাড়ী-বাঙালীর মাঝে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নানিয়ারচরের পূর্ব পাশের লেক এলাকা থেকে ৭০ জেএসএস কর্মীকে অপহরণ করে ৫ মাস পরে মুক্তি দেয়া হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে পাহাড়ী এক সেনা কর্মকর্তার জামাতাকে অপহরণ করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। গত ৬ নবেম্বর নানিয়ারচরের পূর্ব পাশ থেকে ৩ বন কর্মকর্তাকে অপহরণ করা হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পনের দিন পর এদের মুক্তি দেয়া হয়। সর্বশেষ গত সোম ও মঙ্গলবার নানিয়ারচরে হিংসাত্মক পর পর দুটি ঘটনার জন্ম নিয়েছে। এদিকে নানিয়ারচরের ঘটনা ও কাপ্তাইয়ে ছবি মারমার খুনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বুধবার রাঙ্গামাটিতে জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে। এলাকার ভূমি রক্ষা কমিটি পাহাড়ী পল্লীতে হামলার বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি-নানিয়ারচর সড়ক অবরোধ অব্যাহত রয়েছে। বগাছড়িতে ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিকদের পক্ষে হয়েছে মানববন্ধন। উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি মানববন্ধনের ঘটনায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। বুধবার বিকেলে পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, জেলা প্রশাসক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তাদের পক্ষ থেকে যে খয়রাতি সাহায্য নেয়া হয়েছিল, তা উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের দাবি ক্ষতির তুলনায় সাহায্য অপ্রতুল। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সাহায্য হিসেবে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে।
×