ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃত-অপ্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ডামাডোলে ‘নেপোয় মারছে দই’

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

প্রকৃত-অপ্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ডামাডোলে ‘নেপোয় মারছে দই’

তপন বিশ্বাস ॥ দেশে প্রকৃত ও অপ্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে চলছে নানাবিধ তৎপরতা। এই ডামাডোলে অনেকে ফায়দা লোটার পাঁয়তারা করছে। একটি গ্রুপ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এটিও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে একটি অংশ। এতে কোন কোন সময় সরকারও বিব্রত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। সরকারের বিগত আমলের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের জন্য মাসিকভাতা বৃদ্ধি করে। এতে কোন কোন ক্ষেত্রে অমুক্তিযোদ্ধারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখান। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের চাকরির কোটা নিশ্চিত করা, তাদের সন্তান, নাতি-নাতনি ও পোষ্যদের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সরকার। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারী চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। অনেক অমুক্তিযোদ্ধারা তখন থেকে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিতে শুরু করে। এই সুযোগে মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তারাও উপঢৌকনের বিনিময় সমানে সার্টিফিকেট দিতে থাকেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায়র প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়। এ নিয়ে দেখা দেয় নানা বিপত্তি। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন করে সার্টিফিকেট না দেয়ার নির্দেশ দেন। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করতে নানাবিধ উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সুযোগে একটি মহল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে কালিমা লাগাতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের উস্কানিতে মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকা-ে দেশের এই বীর সন্তানদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরিতে জেলা উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে থাকা কোন কোন নেতা টাকার বিনিময়ে নতুন তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে একটি মহল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে কালিমা লেপনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সরকারের নিবেদিতপ্রাণ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। সম্প্রতি একটি বিশেষ পত্রিকার মাধ্যমে ১৬ সচিবকে অমুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ১৬ সচিবের অধিকাংশই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে রয়েছেন কৃষি সচিব এস এম নাজমুল ইসলাম, তৎকালীন (১৬-১১-১৪ তারিখে) প্রবাসী ও কর্মসংস্থান সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব কাজী আখতার হোসেন, ওএসডি সচিব নুরুল হক, সাবেক সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস, রাজউকের চেয়ারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত সাহাব উল্লাহ, মাইন উদ্দিন খন্দকার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সদ্য অবসরে যাওয়া সচিব ফণীভূষণ চৌধুরী, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব এ এস এম আলী কবীর, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ সচিব ফিরোজ কিবরিয়া, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম আজিজুল হক, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব খলিলুর রহমান ও ক্যাডার বহির্ভূত সাবেক কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হোসাইন। সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৭ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ০৩.০৭৭.০১.০৪৬.০০.০৪.২০১০ স্মারকে জারি করা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বয়স বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘নিম্ন বর্ণিত মানদ-ের আলোকে কোন সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধ গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে; যে সব কর্মকর্তা/কর্মচারী সরকারী চাকরিতে অনুপ্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন; অথবা যাঁদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল; অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল; অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরযুক্ত সনদ গ্রহণ করেছেন।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই আদেশে স্পষ্ট বলা রয়েছে, এই চারটির যে কোন একটি শর্ত পূরণ থাকলে তিনি সরকারী চাকরিতে বর্ধিত সময় পর্যন্ত চাকরি করার সুযোগ পাবেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই তালিকার এক নম্বরে থাকা কৃষি সচিব এস এম নাজমুল ইসলামের ক্ষেত্রে এই চারটি শর্তই পূরণ রয়েছে। তাঁর মুক্তিবার্তা (লাল) নং ০১১৭১২০৩২২। চাকরিতে প্রবেশের সময় তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রকাশিত গেজেটেও তাঁর নাম রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরযুক্ত সনদও রয়েছে তাঁর। তারপরও তাঁকে অমুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপতৎপতরা করা হয়েছে। এছাড়া জানা গেছে, খোন্দকার শওকত হোসেন, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব কাজী আখতার হোসেন, ওএসডি সচিব নুরুল হক, সাবেক সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস, রাজউকের চেয়ারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া, পিএসসির সদস্য মাইন উদ্দিন খন্দকার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সদ্য অবসরে যাওয়া সচিব ফণীভূষণ চৌধুরী, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব এ এস এম আলী কবীর প্রত্যেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের প্রত্যেকেরই এই চারটির অন্তত একটি করে শর্ত পূরণ রয়েছে। কারও কারও রয়েছে একাধিক শর্ত পূরণ। এর মধ্যে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের গেজেট রয়েছে। রয়েছে মুক্তিবার্তায় নাম ও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট। সাবেক সচিব ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস এখন রয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। তিনিও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। সূত্র জানায়, এঁদের অধিকাংশই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধ। কিন্তু তাদের অমুক্তিযোদ্ধা বানানোর একটি মিশন চলছে। এমনকি, পিএসসির সদস্য থাকা অবস্থায় মাইন উদ্দিন খন্দকারকে অমুক্তিযোদ্ধা বানানোর এই অপচেষ্টার কয়েকদিন পর (হার্টের রোগী) তিনি হৃদরোগে মারা যান। কেউ কেউ বলছেন বিশেষ এই পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের কারণে তিনি হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। সদ্য অবসরে যাওয়া সচিব এবং পিএসসির সদস্য ফণীভূষণ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, পত্রিকাটির রিপোর্টার আমার কাছে থেকে শুনেছে এক এবং প্রতিবেদনে ভিন্ন কিছু প্রকাশ করেছেন।
×