ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ

সুন্দরবন এলাকায় গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘেরগুলো পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকিÑ এই অভিযোগটি দীর্ঘদিনের। এসব অপরিকল্পিত ও অবৈধ ঘেরের কারণেই ধ্বংস হয়েছে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌরুট এ বিষয়টিও এখন স্পষ্ট। গত সপ্তাহে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শ্যালা নদীতে জ্বালানি তেলের ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় তেল ছড়িয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই বিষয়টি আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মংলা-রামপাল এলাকায় চিংড়ি ঘেরের বিস্তার-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-চ্যানেল থেকে আশপাশের অসংখ্য সংযোগ খাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে জোয়ার-ভাটার গতি হারিয়ে দ্রুত বালু জমে ভরাট হয়ে গেছে এই চ্যানেলের প্রায় ২৮ কিলোমিটার নৌপথ। জানা গেছে, এ কারণে মংলাবন্দরে যাতায়াতকারী নৌযানগুলো বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে শ্যালা নদীর পথটি। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে মংলাবন্দর। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। বলা চলে বৈধ-অবৈধ নানাভাবে মাছের চাষ করে এই এলাকার নদীপথগুলোকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলা হচ্ছে। এমতাবস্থায় ঘষিয়াখালী চ্যানেল উদ্ধারে ওই খালের মুখে থাকা চিংড়ি ঘেরগুলো বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ কার্যকর হলে মংলা বন্দরে যেতে সাত থেকে আট কিলোমিটার পথ কমে যাবে। উল্লেখ্য, মংলার নালা ও রামপালের কুমার নদী ভরাট হয়ে ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ। সেই থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের ওই ট্যাঙ্কারডুবির পর প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা এলো। চিংড়ি চাষের জন্য লবণাক্ত পানি সবচেয়ে উপযোগী। তাই এখন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশেই চিংড়ি চাষ হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতেও চিংড়ি শিল্প ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। চিংড়ি রফতানি বাংলাদেশের রফতানি শিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। চিংড়ি শিল্প বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ এটা যেমন সত্য তেমনি এই শিল্প আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ এবং স্বাস্থ্যের ওপর খানিকটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। চিংড়ি চাষ অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা ধানের পরিবর্তে চিংড়ি চাষকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। স্বল্প শ্রমে এবং তুলনামূলক কম মূলধনে অধিক মুনাফা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ধান চাষের প্রতিকূলতা কৃষকদের চিংড়ি চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। বিপরীতে চিংড়ি চাষের বিস্তার উপকূলীয় পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চিংড়ি চাষ বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমির পরিমাণ শুধু দিন দিন হ্রাসই পাচ্ছে না, সেই সঙ্গে খাল-বিল ডোবা এমনকি ছোট ছোট নদীও দখল হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। এই বিশাল জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নানা কারণে সুবিধাবঞ্চিত। সিংহভাগ মানুষের পেশা কৃষি। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব এবং মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের কারণে কৃষকের পেশা আজ বিলীন হওয়ার পথে। অনেক কৃষকই তার পেশা বদল করেছেন। অন্য কাজ না জানায় বেকার হচ্ছে অসংখ্য কৃষক। চিংড়ি চাষের কারণে অনেক জমিই আবাদশূন্য রাখতে হচ্ছে। কৃষি প্রধান হিসেবে উপকূলীয় এই অঞ্চলটির যেমন সুনাম রয়েছে তেমনি নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌ-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রও এটি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশটি যথাযথভাবে পালন করা গেলে এই দুটি ক্ষেত্রই যে রক্ষা পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকা আরও কঠোর হওয়া দরকার।
×