ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজয়ের তেতাল্লিশ বছর বড় বড় অর্জন কী

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

বিজয়ের তেতাল্লিশ বছর বড় বড় অর্জন কী

শুক্রবারের কলাম লিখছি মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। আমার সামনে অনেক দৈনিক কাগজ। এগুলো ঘাঁটছি। বিশেষ সংখ্যাগুলো দেখছি। যেগুলো পড়ার মতো সেগুলো পড়ছি। এসব করতে করতে চলে গেলাম অনেক পেছনে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আর আজ ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সময়ের হিসাবে কম নয়। বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ বছর। বলা যায় দেখতে দেখতেই কেটে গেছে অথচ মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক সময়। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ কি এগিয়েছে, না পিছিয়েছে? এই চার দশাধিক সময়ে মধ্যে কী কী আমাদের অর্জন, আর কী কী আমাদের ব্যর্থতা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমি যাব না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি আলোচনাতেও যাব না। এসব প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে সবাই করছেন যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি সামান্য আলোকপাত করতে চাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের ওপর। স্বাধীনতার পূর্বে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁরা বলতেন, স্বাধীন হবে খাবে কী? তোমাদের আছে কী? একটুখানি জমি, দুই মোটা পাট, আর দুই কাপ চাÑ এই দিয়ে স্বাধীনতা? আছে কিছু চামড়া। স্বাধীনতার জন্য শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি লাগে, শক্ত জাতীয় বুর্জোয়া লাগে, যাদের পুঁজি আছে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী লাগে। এসবের কিছুই নেই। ‘পাকিপন্থীরা’ আরও বলত, বাংলাদেশের তিন দিকে ‘শত্রু’ ভারত। একদিকে খোলাÑ বঙ্গোপসাগর। এমতাবস্থায় স্বাধীনতা নৈব চ নৈব চ। শক্তিশালী ‘পাকিস্তানের’ অঙ্গ আছ, শান্তিতে থাক। এসব প্রচারণার বিরুদ্ধেই ছিল বাঙালীর অবস্থান। এই অবস্থান থেকেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, চীন-মার্কিনসহ বলতে গেলে সারাবিশ্ব আমাদের বিরুদ্ধে। বন্ধু কেবল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থাৎ বর্তমান রাশিয়া। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বরে পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন। আজকে কী মনে হয়? যে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীনতা, আমরা কী তাদের থেকে পিছিয়ে আছি? আমরা কী- এমনকি বন্ধুদেশ ভারত থেকে পিছিয়ে? বিজয় দিবসেই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম আমরা মৌলিক কয়েকটা মানদ-ে পাকিস্তান থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। বর্তমান পাকিস্তান দেশটি অভ্যন্তরীণ ‘যুদ্ধে’ ক্ষত-বিক্ষত। তার ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ, রফতানি আয়ে তারা বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে। রেমিটেন্স আয়ে তারা আমাদের থেকে পিছিয়ে। গড় আয়ু আমাদের বেশি। শিশু মৃত্যুর হার পাকিস্তানে অনেক বেশি। বাংলাদেশ বিগত ৫-৬ বছর যাবত অবিরাম ৬ শতাংশের ওপরের হারে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি করে চলেছে অথচ পাকিস্তানের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার চার শতাংশের বেশ নিচে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমাদের রফতানি আয় ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের ছিল সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার। রেমিটেন্স আয় বাংলাদেশের ছিল ১৪ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে পাকিস্তানের ছিল মাত্র ৯ বিলিয়ন ডলার। গড় আয়ু আমাদের ৬৯ আর পাকিস্তানীদের ৬৫। শিশুমৃত্যুর হার প্রতিহাজারে বাংলাদেশের ৩৭ আর পাকিস্তানে ৫৯। যাঁরা এখনও বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নে বিভোর তাঁরা এই তথ্য দেখে কি বলবেন? বলবেন পাকিস্তানীরা আমাদের চেয়ে ভাল আছে? পাগল অথবা মতলববাজ না হলে একথা বলার কথা নয়। সঙ্গে দিই আরেকটা তথ্য। ১৯৭১ সালের পূর্বে পাকিস্তানী এক রুপী দিলে ভারতে পাওয়া যেত এক রুপী বিশ-ত্রিশ পয়সা। শক্ত ছিল তাদের ডলার- রুপী মূল্যও। আর আজ? আমরা বাংলাদেশীরা একটা ডলার কিনি ৮০ টাকায়। পাকিস্তানীরা ডলার কিনে শতাধিক রুপী দিয়ে। কী বোঝা গেল? আমাদের টাকার মূল্য ডলারের তুলনায় পাকিস্তানের রুপীর তুলনায় তেজি। এই গেল পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা। প্রতিবেশী ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি আমাদের তুলনায় অনেক শক্ত। তারা সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। তাদের অর্থনৈতিক মৌলিক ভিত্তিগুলো বেশ মজবুত। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগামী। যেমন ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার। গত দুই বছর যাবত ভারতের ‘জিপিডি’ প্রবৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশের নিচে অথচ বাংলাদেশে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে। দারিদ্র্য হার হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রাপ্যতা, নিরাপদ সেনিটেশন ইত্যাদির নিরিখেও বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। এবার আসা যাক অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে। বিগত ৪২-৪৩ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, ব্যবসা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি-সাফল্য কী, ব্যর্থতাই বা কী? অর্থনৈতিক সার্বিক চিত্রের অনেক দিক আছে যেমন : জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, আমদানি-রফতানি, রেমিটেন্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, শিল্পায়ন, কৃষি উন্নয়ন ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেক দিকে আছে দেশে এখন কতজন কোটিপতি আছেন, কত লাখ লোক আয়কর দেন, কত লাখ লোক দেশের বাইরে কর্মরত আছেন, কত লোক দেশ থেকে বিদেশকেই নিজেদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করছেন? কত হাজার লোক বড় মাঝারি শিল্পের মালিক হয়েছেন? দেশের কোন্্ অঞ্চল উন্নত, কোন্্ অঞ্চল কম উন্নত? এমনসব হাজারো প্রশ্ন আছে। এতসব বিষয় অল্প পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। অতএব, দেখা যাক সাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে। সাধারণ মানুষ ভাত-কাপড় পাচ্ছে কিনা। মানুষ দুইবেলা পেটপুরে খেতে পারছে কিনা। এই প্রশ্নগুলো আমার কাছে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাকি বিষয়ের গুরুত্ব আছে। তবে সাধারণ মানুষ ভাত, মাছ দুধ, ডিম ইত্যাদি পাচ্ছে কিনা এই প্রশ্নগুলো অর্থনীতির মূল বিষয় অর্থাৎ দেখা দরকার এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি কতটুকু। ১৯৭১ সালের পূর্বে আমাদের কৃষির অবস্থা কী ছিল? বিজয় দিবসের প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এসব তথ্য একসঙ্গে পাওয়া গেল। স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের আবাদী জমি ছিল সোয়া দুই কোটি একর। সেই আবাদী জমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে নানা কারণে। এর মধ্যে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ, অফিস-আদালত নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণ, অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্পের জন্য জমি ব্যবহার প্রধান। দেখা যাচ্ছে এসব খাতে প্রতিবছর আবাদী জমির এক শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই আবাদী জামির পরিমাণ সোয়া দুই কোটি একর থেকে হ্রাস পেয়ে এক কোটি ৮৮ লাখ একর হয়েছে। উল্লেখ্য, এতদসত্ত্বেও চালের উৎপাদন সাড়ে তিন-চারগুণ বেড়েছ। স্বাধীনতার পূর্বে চালের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি টনের নিচে। আজ এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন অথচ লোক সংখ্যা বেড়েছে মাত্র দ্বিগুণ। স্বাধীনতার পূর্বে আমাদের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র সাত-সাড়ে সাত কোটি। এখন পনেরো-ষোলো কোটি। তবে কথা আছে। স্বাধীনতার পূর্বে ৬০-৭০ শতাংশ লোক খাবার পেত না। দুই বেলা ভাত পেত না। এখন এর সংখ্যা মাত্র ২৫ শাতাংশ। এরমধ্যে অতি দরিদ্র অবশ্য ১০-১২ শতাংশ লোক। এর দ্বারা বোঝা যায় দৃশ্যত খাদ্য উদ্বৃত্তের অবস্থা হলেও প্রকৃত অর্থে তা নয়। চলে উৎপাদনের সঙ্গে আরেকটা ঘটনা ঘটে গেছে। এখন সারাবছরই জমি ব্যস্ত থাকে। কোন না কোন ফসল মাঠে থাকেই। শাক-সবজি বাজারে শীত নেই, বর্ষা নেই, গ্রীষ্ম নেই সব সময়ই পাওয়া যায়। এর দ্বারা শুধু ভোক্তাদের প্রয়োজনই মিটছে না কৃষকরাও উপকৃত। তারা এক ফসল থেকে অন্য ফসলে যেতে পারে। যেটা লাভজনক সেটাতেই। ফসলের দাম অর্থাৎ শাক-সবজি অথবা চালের দামও যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে। তা অনেকটা সহনশীল। এক রিক্সাওয়ালা ঢাকায় দিনে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার করে। যদি ৩০০ টাকাও ধরি তাহলে এই বাজারে ৮-১০ কেজি চাল অথবা সবজি পাওয়া যায়। এই হিসাব কিন্তু পাকিস্তান আমলে সত্য ছিল না। এখন একজন শ্রমজীবী মানুষ তার দৈনিক রোজগারে ১০ কেজি চাল ক্রয় করতে পারত না। চাল ও সবজির কথা বাদ দিই। আসি মাছের প্রশ্নে। একথা ঠিক দেশীয় জাতের মাছের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে গেছে। কিন্তু চাষের মাছের উৎপাদন বেড়েছে বেশ। শিং, মাগুর, কৈ, পাবদা থেকে শুরু করে এখন প্রায় সব ধরনের মাছই চাষ হয়। পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। মানুষ নতুন নতুন পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে। রাজশাহী অঞ্চল থেকে জ্যান্ত চাষের মাছ এখন ঢাকার বাজারে আসে। ভোরে তা বাজারে পাওয়া যায়। এক হিসাবে দেখা যায় মাছের সরবরাহ বেড়েছে প্রায় চারগুণ। এর অধিকাংশই নদীর মাছ নয়, পুকুরের চাষ করা মাছ। বাড়ে না বাড়ে না করেই দুধের উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে ডিমের উৎপাদনও। উভয়ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার চার-পাঁচগুণ। ওপরে যে চাল, সবজি, মাছ, ডিম ও দুধের একটা হিসাব তুলে ধরলাম তা থেকে বোঝা যায় এসব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমাদের অর্জন খুবই প্রশংসনীয়। তবে এখানে একটাই সাবধান বাণী আর সেটা হচ্ছে আয় বৈষম্য। ঢাকা শহরের রিক্সাওয়ালার আয়ের যে চিত্র দিলাম তা বাংলাদেশের চিত্র নয়। দেশের উত্তরাঞ্চলে এই রোজগার নেই বলেই রিক্সাওয়ালারা ঢাকায় আসে। কয়েক দিন কাজ করার পর আবার দেশে চলে যায়। আবার ঢাকায় আসে। প্রথমত শ্রমজীবী মানুষের সারাবছর রোজগারের ব্যবস্থা চাই এবং রোজগারের পরিমাণটাও দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মানানসই হওয়া চাই। এই জায়গায় আমাদের দুর্বলতা রয়ে গেছে। বৈষম্যের ব্যাপারে এতদিন কোন কথা হয়নি। আশার কথা এখন হচ্ছে। আগামী পরিকল্পনায় এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে বলা হচ্ছে। মোটকথা প্রতিবেশীদের তুলনায় আমরা ভাল করছি। দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদাও মেটানো হচ্ছে। অগ্রগতি প্রশংসনীয়। ৪২-৪৩ বছরে এই অর্জন কম নয়। তবে আয় বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ জরুরী। লেখক : সাবেক প্রফেসর বিআইবিএম
×