ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বুলেটবিদ্ধ পাকিস্তানের ঘুম কবে ভাঙবে ?

প্রকাশিত: ০২:৫৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

বুলেটবিদ্ধ পাকিস্তানের ঘুম কবে ভাঙবে ?

অদূরবর্তী সময়ে বার বার এই দেশ সব রকমের নৃশংস হত্যা, মৃত্যু, বিস্ফোরণ- এসব ভুলে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু নাহ্, এবারের মৃত্যুগুলো আর কেউ ভুলে গিয়ে এগোতে পারবে না। শেষ এক দশকের বেশি সময় ধরেই পাকিস্তানীরা তাদের সহ্যশক্তি বাড়িয়েছে বা অন্যভাবে বললে তাপ-উত্তাপহীন হয়ে পড়েছে কোনরকম মৃত্যু সংক্রান্ত খবরে। কারণ দেশজুড়ে প্রতিনিয়তই হত্যা, বিস্ফোরণ ঘটেই চলেছে। তাই এতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু ডিসেম্বর ১৬-এর ট্র্যাজেডি এক ঝটকায় এই অভ্যাসেও লাগাম পরিয়েছে। এই ব্যর্থতা সমগ্র দেশেরই। কারণ শিশুদের কাছে বাসগৃহের পরের নিরাপদ জায়গাটি তাদের স্কুল। আর সেখানেই একটা দেশ সুরক্ষা দিতে পারল না! তালেবান জঙ্গীরা পাক সরকারের সঙ্গে কোন দাবি-দাওয়া নিয়ে দরদাম করার জন্য স্কুল দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। তারা ৫ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ছাত্রদের খতম করতেই এসেছিল, ১৫০ শিশুর নিঃশ্বাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা জায়গা থেকে সরেনি বা সরানো যায়নি। যে ৯ শিক্ষক সাহস দেখিয়ে বাঁচাতে ছুটে এসেছেন, তাঁরা মুহূর্তেই বুলেটবিদ্ধ হয়ে ছিটকে গেছেন। প্রিন্সিপালকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রদের সামনে। হলিউড থ্রিডি এ্যাকশন সিনেমার সুপার ইম্পোজ দৃশ্যও হার মেনেছে এই ভয়াবহতা। এক ডজনেরও বেশি বিস্ফোরক উড়িয়ে দিয়েছে, দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে ক্লাসরুম। মায়ের কোল ছেড়ে, বাবার বুকের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে সকালে স্কুলে আসা সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন শয়ে শয়ে বাচ্চাকে আট ঘণ্টা ধরে এ্যামবুশে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তেহরিক-ই-তালেবানের ৮ জঙ্গী। এর চেয়ে বড় মানবিক ট্র্যাজেডি হতেই পারে না। পৃথিবীতে এর আগেও হয়নি। স্কুলই তালেবানদের পছন্দের টার্গেট। কারণ, এই একটা জায়গাতেই তাদের এই অসত্য ইসলামিক আদর্শে আঘাত আসতে পারে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় বসার ঠিক পরেই ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা বাতিল করেছিল। মালালাকেও পড়াশোনা করার অপরাধে গুলি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ধর্মের আফিমে সম্পূর্ণ মুড়ে থাকা দেশের মানুষ বলেছে, আর এখন নোবেল পাওয়ার পরেও বলছে, মালালা পশ্চিমী এজেন্ট। তাহলে এই ১৫০ শিশু কার এজেন্ট ছিল? আর বাকি আহতরা আেন্ দেশের কোন্ শক্তির এজেন্ট? বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব একের পর এক শিশুদের কবর দিয়েই চলেছেন- এই দৃশ্য গহ্বরের গভীরতম অন্ধকার। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ৯০০ জনকে উদ্ধার করার পর অপারেশনটিকে ‘সফল’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে- কিন্তু যে ঘটনায় ১৫০ নিরীহ শিশুর প্রাণ যায় তার সঙ্গে ‘সফল’ শব্দটি কি যুক্ত করা যায়? বড় বিভ্রান্ত সকলেই- এই ট্র্যাজেডি মেনে নেয়ার মতো মন তো কারও তৈরিই হয়নি। এই ব্যথার তো কোন শেষ নেই। যাই ঘটুক, যত বোমাই ফাটুক, যত গুলিই চলুক, শিশুরা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরের থাকবে। শিশুদের ওপর কোন কারণে কখনই হামলা চালানো যেতে পারে না। কিন্তু তালেবানরা বরাবর তাই-ই করে আসছে তাদের নিজস্ব সৃষ্ট ইসলাম প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে। এই তো মাত্র এক বছর আগে খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলের ১৪ বছরের কিশোর ইজাজ তার নিজের জীবন দিয়ে স্কুলে নাশকতার উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়া এক আত্মঘাতী জঙ্গীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল এরকমই শত শত নিরীহ শিক্ষার্থীরকে। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈৎরংরং এৎড়ঁঢ়-এর এক প্রতিবেদন বলছে, গত পাঁচ বছরে তালেবানরা অন্তত ১ হাজার স্কুলে হামলা চালিয়েছে। পেশোয়ারের আরেক নাম ফুলের শহর। তালেবানরা শিশুদের রক্ত দিয়ে হোলি খেলার জন্য এই শহরই বেছে নিল। অবশ্য এর আগেও গত বছর এখানকার পুরনো ক্রাইস্ট চার্চে তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১২০ জনকে হত্যা করে। এই ঘটনার এক মাসের মধ্যেই আবার পেশোয়ারে সবচেয়ে পুরনো কিসসা খিয়ানিবাজারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৫০ জনকে হত্যা করে। আর এ বছর করাচী বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করেছে। আর মাত্র ক’দিন আগেই ওয়াঘাতে হামলা চালিয়ে ৬০ জনকে খতম করেছে। এটাই এদের শেষ এক বছরের রিপোর্ট কার্ড। এরা এখন চাইছে পাকিস্তানের আইএসআইএস হতে! যে দেশে ১৪ বছরের স্কুলে ফেরতা কিশোরীর মাথায় গুলি খাওয়াকে পরবর্তীকালে ‘নাটক’ বলা হয়, আরও বলা হয় যে, ‘তেমন আহত’ হয়নি সেই দেশে তালেবানরা পর পর এমন হামলা করার এমনিতেই হকদার। যুক্তির বিচার দাবি করে এমন গোয়েন্দা ব্যর্থতা কেন ঘটল সেনাবাহিনীকে তার জবাব দিতে হবে। পেশোয়ারসহ দেশজুড়ে বিভিন্ন শহরে বিগত বছরগুলো ধরে এমন মর্মান্তিক ঘটনা পর পর ঘটেই চলেছে, কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছেন। প্রত্যেক বড় শহরেই বিশাল সেনাঘাঁটি মজুদ রয়েছে। দেশের রাজনীতিবিদদের অবস্থাও চাচা আপন প্রাণ বাঁচার মতো। শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বইছে প্রধানমন্ত্রীর। কোন সাহসী পদক্ষেপ নিতে যাওয়ার কথা ভেবেই তিন পা পিছিয়ে আসেন শরীফ। অথচ সংসদে তাঁর দল নিরঙ্কুশ। ক্ষমতায় আসার পরে এই বর্বর তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। আর অন্যদিকে দেশের বিরোধী নেতা ইমরান তো তালেবানদের দেশের বিপদ বলে মানতেই নারাজ। এই খাইবার পাখতুনখোয়া রাজ্যে ইমরানের দলেরই সরকার আর তার দলের মুখ্যমন্ত্রী কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন- পেশোয়ারে তালেবানরা অফিস খুলতে চাইলে জায়গা দেয়া হবে। শৈশবের এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পরেও কি এই দেশের ঘুম ভাঙবে? মুসলমানকে খুন করে মুসলিমদের শেখাতে হবে সাচ্চা মুসলমান হওয়ার সবক? এ পৃথিবীর অন্ধকারের কীটেরা যে রাজনীতিতে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করতে চেয়ে মুখোশ পরে একবার রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসছে আর একবার মালালা, ইজাজদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে; এই দ্বিচারিতা উপড়ে ফেলা দরকার। বিধ্বস্ত, রক্তে ভেজা লেপ্টে যাওয়া মৃত শিশুদের হাতে জলের বোতল, কারও হাতে স্কুলব্যাগ আঁকড়ে থাকার ছবি পাকিস্তানের মানুষদের মানসিক রোগী করে দিতে পারে। করুক, কারণ এটা জরুরী। তারা তো একের পর এক ভুলেই চলেছে সমস্ত ঘটনা। কিন্তু নিজেদের শিশুদের এই রক্তমাখা হাতে বাঁচার আর্তি তো ভোলা যাবে না! এই ধর্মান্ধতা, এই পৈশাচিক জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে লড়াই শুরু করতেই হবে, তা হলে রাষ্ট্রও আর আঁতাত করে চলার সাহস দেখাতে পারবে না। তাই দ্বিতীয়বার কিন্তু আর ভাবার সুযোগ নেই, ভুলে যাওয়ারও সুযোগ নেই- আজকের পাকিস্তান এই রক্তাত পেশোয়ারেই বেঁচে থাকবে যতক্ষণ না জঙ্গীবাদ সম্পূর্ণ বিনাশ হয়। [email protected]
×