ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে সব দলের একমত প্রয়োজন ॥ ড. কামাল

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২১ ডিসেম্বর ২০১৪

সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে সব দলের একমত প্রয়োজন ॥ ড. কামাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গণফোরাম সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রে সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য হবে নাÑএটাই স্বাভাবিক। তবে সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে সব দলের একমত হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। তিনি বলেন, শুধু নির্বাচন দিয়েই কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা কি স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছি? রাজনীতিবিদদেরই এ জন্য দায় নিতে হবে। অতীতের সব বাহাস, অভিযোগ ভুলে গিয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে আলোচানার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছতে হবে। শনিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টার ইনে একটি গবেষণা প্রতিবেদনের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন এ সব কথা বলেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব গবর্নেন্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে মন্তব্য করে ড. কামাল হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে হলে একটি পথ বের করতে হবে। সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচন হবেÑএটাই এখন সবার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার বিষয়ে কারও কোন দ্বিমত নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭০, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে কমিশনের সোচ্চার ভূমিকার কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দেশের প্রধান দুই দলকে সংলাপে বসারও আহ্বান জানিয়ে সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম এই সদস্য বলেন, সমস্যা সমাধানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপে বসতে হবে। সেই সঙ্গে ছোট-বড় অন্যান্য দলকেও সংলাপ প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে হবে। তবে সংলাপের ভিত্তি সংবিধানের মূলনীতি মেনেই হওয়া উচিত। তিনি বলেন, মেধাবী ও যোগ্য হলে নিজ দলের কাউকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো অন্যায় নয়। তবে সব জায়গায় মেধাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু ৩৫ বছর বয়সে মন্ত্রী হয়েছিলেন। দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ তরুণ। তাই দেশ গঠনে তাদের মেধাকেও কাজে লাগাতে হবে। দায়িত্ব তুলে দিতে হবে তাদের কাঁধে। এ সময় তিনি রাজনীতিতে তরুণদের কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান জানান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পুনরায় প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের চর্চা জোরদার করার জন্য সব বিশ্ব¦বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানান ড. কামাল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না হলে দেশে আরও একটি ওয়ান ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, সংবিধানের মূলনীতির ভেতরে থেকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। মহাজোট সরকার সেটাই করেছে। এখন সমালোচকরাও স্বীকার করছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকার ও সুশাসন আছে বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে। বিএনপিকে উদ্দেশ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, রাজনীতিতে পূর্বশর্ত দিয়ে কোন সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা হয় না। সংলাপের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার বললে, সিপিএ-আইপিইউর সভাপতির নির্বাচিত পদ সরকার টাকা দিয়ে কিনেছে বললে সে পরিবেশ তৈরি হবে না। তেলে-জলে কিংবা আগুনে পানিতে কখনও সংলাপের আশা করা যায় না। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সাংবিধানিক শাসন মেনেই সংলাপ করতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী এবং স্বাধীনতার পক্ষের মধ্যে কোন সংলাপ হতে পারে না। তবে যে কোন জাতীয় ইস্যুতে সরকার সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক ও প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, সংসদ মানেই গণতন্ত্র না। গণতন্ত্রে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সেগুলোকেও শক্তিশালী করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের সমালোচনা হচ্ছে। এটি চিরস্থায়ী কোন ব্যবস্থা নয়। জনগণের ম্যান্ডেট ও প্রয়োজন মনে করলে যে কোন দল তা আবারও সংশোধন করতে পারবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রাজনীতির মাঠে একটি দল কার সঙ্গে জোট করবে, কার সঙ্গ ত্যাগ করবে সে সিদ্ধান্তের ভার সে দলের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। বিশেষ কোন দলের সুবিধা বিবেচনায় ও পরামর্শে বিএনপি কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। তিনি আরও বলেন, দলের ভেতর গণতন্ত্রের পাশাপাশি দেশে একটি প্রতনিধিত্বমূলক সরকারও থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার অনুপস্থিত। অনুষ্ঠানের প্যানেল আলোচক বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি রাজনৈতিক উন্নয়নকে ছাপিয়ে যায় তাহলে সমাজে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অধোগতি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ভর করেই বেঁচে আছে। তিনি বলেন, কৃষি, গার্মেন্টস ও প্রবাসী খাতে বেশির ভাগ শ্রমিক অদক্ষ। অদক্ষ শ্রমিকরা যখন অর্থনীতির ধারক হন তখন তাঁরা গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে পারেন না। মধ্যবিত্ত শ্রেণী সুবিধাভোগী বলেই জাতীয় বিভিন্ন সঙ্কটে তাঁরা নীরব থাকেন। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতন্ত্র। সংলাপের মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিনায়ক সেন আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগ করার এবং জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের ত্যাগ করার আহ্বানও জানান তিনি। প্যানেল আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের রাজনীতির ভাষা অনেক বদলে গেছে। রাজনীতিবিদরা এখন জনগণের ভাষায় কথা বলেন না। অতীতের রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসেননি। কিন্তু এখনকার রাজনীতিবিদদের মধ্যে পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা লক্ষণীয়। তিনি বলেন, সুশাসনের অভাব প্রশাসন লাভজনক হয়ে উঠেছে। ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুশাসনের অভাবই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বাংলাদেশের শাসন পরিস্থিতি ২০১৩ : গণতন্ত্র, দল, রাজনীতি’ শীর্ষক ব্র্যাকের ১৪০ পৃষ্ঠার এ গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা, বাক-স্বাধীনতা, সহিংসতা, রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন, মনোনয়ন পদ্ধতি, সংসদে ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলাদের আধিপত্য, পারিবারিক রাজনীতির চর্চা, সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন এবং পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয়করণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সংবাদপত্রের সংবাদ, জরিপ, বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে বিশিষ্ট নাগরিকদের সাক্ষাতকার ও বইয়ের তথ্য। এটি বিআইজিডির সুশাসন বিষয়ে সপ্তম প্রতিবেদন। বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতান হাফিজ রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেনÑ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, গবেষণা প্রতিবেদনের সমন্বয়ক মিনহাজ মাহমুদ, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারী সংস্থা, দাতাগোষ্ঠীসহ দেশী-বিদেশী সংস্থার প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
×