ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি আওয়াজ-এ-পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

বিএনপি আওয়াজ-এ-পাকিস্তান

‘গায়েবি আওয়াজ নয়’- মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বেশ উচ্চনাদে আবারও আওয়াজ তুললেন প্রতিপক্ষের প্রতি- ‘গজব নাযেল’ হবে। প্রয়োজনে ‘জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলার’ মতো নৃশংস বাক্যও বেশ ক্রোধের সঙ্গে উচ্চারিত হলো। বোঝা গেল, এসবই রাজনীতি, রাজনীতির নব্যভাষা। কিন্তু এ ভাষা কোন রাজনীতিকের ভাষ্য হতে পারে, বিশ শতকেও ভাবনার মধ্যে ছিল না। একুশ শতকে এসে পাকিস্তানী শাসকদের পুরনো ভাষ্যের পুনরাবৃত্তি শ্রবণেন্দ্রিয়কে বেশ পীড়িত করে বৈকি। গ্রাম্য ঝগড়ায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগে যা উচ্চারিত হয়, তা এখন রাজনীতিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাকে গ্রাম্যতার উর্ধগতি নাকি অধোগতি বলা হবে তা পরিষ্কার নয়। উস্কানির নানা ধরন-ধারণ থাকে। এ-ও তারই একরকম অংশ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী ভাষা মাতা-পুত্র মিলে যেভাবে উচ্চারণ করছেন তা পাকিস্তানী সিপাহীরা ব্যবহার করত একাত্তর সময় পর্যন্ত। আজ সেই ভাষা বাংলার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায় রাজনীতির নামে, সহিংসতার বিকাশে। তাঁরা একালে যেসব শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করছেন, তা শোভনীয় এমনটা নয়। অকথ্য ভাষায় বকাবকি করাটা দৃশ্যমান হয় নিম্নবর্গের চুলোচুলি, হাতাহাতিকালেই। অতীতেও যেসব শব্দবাণ ছুড়েছেন তার নমুনা সহজেই মেলে না রাজনীতির মঞ্চে। ‘নাকে খত দেয়া’, ‘কান ধরে ওঠবস’, ‘মহাচোর’ থেকে শুরু করে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের সব তীরই ছুড়ছেনÑ কোনকিছুই তাঁরা বাকি রাখছেন না। আরেকটু পেছনে তাকালেই দেখা যায়, ২০১২ সালে ‘এই সরকারের লোকদের যেখানেই পাবেন, তাদের কান ধরে ওঠবস করাবেন’ বলে জনগণকে উস্কে দিতে চেয়েছেন। অবশ্য জনগণ তাতে উদ্দীপ্ত হয়েছে, এমনটা নয়। সর্বশেষ আন্দোলনের চরমপত্র দিয়েছেন তিনি, ‘সরকারকে না হটিয়ে রাজপথ ছাড়বেন না’ অথচ রাজপথে তিনি কিংবা তাঁর অনুসারী কারও অবয়ব দৃশ্যমান নয়। কাঁচে ঘেরা ঘরে বসে রাজপথ জনপদ আন্দোলিত করার দিবাস্বপ্ন মন্দ নয়। কিন্তু স্বপ্নরা দূরগামী হয়ে যায় কেবলই। আন্দোলনের জন্য জনগণকে প্রস্তুতি নেবার যে আহ্বান, সে আহ্বানে সাড়া দেবার মতো জনগণই মেলে না আর দেশে। তাই যতবারই ঘোষণা আসে, অমুক দিবসের পর আন্দোলন, ততবারই আবার তা পিছিয়ে যায়। নদীর ঢেউ আন্দোলিত হয়, গাছের পাতারাও শীতের কাঁপনে দুলে ওঠে; কিন্তু যতই গলাখাঁকারি দিন না কেন দলীয় প্রধানের ডাকে নিজ দল এবং তার ১৯টি পরগাছাও আর ‘আন্দোলন’ নামক খেলায় আন্দোলিত হচ্ছে না। সময় বয়ে যায়, প্রকৃতি রং বদলায়। কিন্তু কেউ আর ঝাঁপিয়ে পড়ে না আন্দোলন নামক খাল-বিল-নালাতে। খানা-খন্দতে পড়ে আহত হতে আর কেউ আগ্রহী নয়। সামনে বসন্ত, কোকিল ডাকবেÑ কাকের বাসায় ডিম পাড়বে বলে। কিন্তু বিএনপির ডিমে তা দেয়া দূরে থাক, ডিম পাড়ার অবস্থাও নেই। শুধু হাঁক ডাকই সার, তা নয়। এর পেছনেও রয়েছে কত রকমারি নীলনক্সা। সেসব নক্সাতে সুঁইয়ের ফোঁড় যথাস্থানে না পড়লে নক্সা বিসদৃশ্য হতে বাধ্য। তাই ষড়যন্ত্রের নক্সাগুলো নীলাভ হয়েই রয়ে যায়। নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে অনেকদিন ধরেই বিদেশীদের প্রভুর স্থানে বসিয়ে খেয়া পাড়ি দেবার ব্যবস্থা করার জন্য সে কী আকুল আবেদন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এন্তার নালিশ জানিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিকার আর হয় না। ‘প্রভুরা হাত ধরে নিয়ে মসনদে আসীন করে দিচ্ছে’ স্বপ্নেই তা মূর্ত হতে পারে। বাস্তবতা তার থেকে সহস্র যোজন দূরে। লক্ষ্য তো একটাই- ক্ষমতা দখল। কিন্তু তা শুধু দখল নয়, দেশের চেহারা পাল্টে দেয়াটাই মুখ্য কাজ। যা অতীতে চেষ্টা চরিত্তির করেও তেমনভাবে পারেনি জনরোষের আধিক্যে। তাই নতুন করে আবার নামতা জপছেন। যে নামতার গাণিতিক সূত্রই জানা নেই। সময়মতো আন্দোলনের ডাক দেবার কথা বলে রাখা হয়েছে। এই সময় কবে আসবে জানেন না তিনি নিজেও। বরং বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকে সময় যাঞ্চা করে বেড়াচ্ছেন। সরকারের পতন ঘটাতে চান। কিন্তু কেন চান? এই চাওয়ার পেছনের মুখ্য কারণ যে দেশবাসী অবহিত নয়, তা তো নয়। ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারে’ সেই বাহাত্তর সাল থেকে একাত্তরের পরাজিত শক্তি সক্রিয়ভাবে কাজ করে আসছে, তিনি তাদের সঙ্গে থেকে, তাদের পরামর্শ মেনে সেই পাকিস্তানী ‘বুলন্দ আওয়াজ’ তুলছেন প্রায় সময়ই। জঙ্গীপনার যে ধারায় পাকিস্তান বিকশিত, তার মহড়া এ দেশবাসী দেখেছে ২০১৩ সালে। ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের পতন ঘটিয়ে’ ক্ষমতায় আসীন হবার যে আয়োজন করেছিলেন, তাতে কত প্রাণ, কত সহায়-সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, তা নিরূপণ করা না হলেও জনগণের মন থেকে তা মুছে যায়নি। পুলিশ হত্যার মহোৎসব দেখেছে দেশবাসী। আর তা সংঘটিত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটের জঙ্গীপনার মহড়ায়। সেই একই দৃশ্যপট তিনি আবারও হাজির করতে চান। তাই বলেছেনও, ‘পুলিশ গুলি চালালে তা রাজপথেই মোকাবেলা করব। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। দেখি পুলিশ কিভাবে গুলি করে?’ অথচ এই তিনি ছিলেন একদা দু’দফায় এ দেশেরই প্রধানমন্ত্রী। যার আমলে ‘জাতীয়তাবাদী পুলিশ দল’ গড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিপক্ষ দলের অভিযোগের সীমা ছিল না। পুলিশকে মোকাবেলা করা মানেই জঙ্গীপনার আচরণকে আবারও সামনে আনা। অবশ্য ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ কাজটি যে তাঁর অজান্তে ঘটেনি, সে তো সাক্ষী-সাবুদদের ভাষ্যেই উঠে আসে। পুলিশের প্রতি সহিংস আচরণের যে নিদর্শন স্থাপন করেছেন গত বছর, তার পুনরাবৃত্তি সহজতর হবে, তা নয়। সরকারকে হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র(!) প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। গলার জোর এবং গায়ের জোরেও গণতন্ত্রের কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের বোধকরি সবার আগে এই বিষয়টি স্থির করা দরকার যে, গণতন্ত্রকে তাঁরা ক্ষমতা আহরণ কিংবা ক্ষমতায় আরোহণের একটি উপায় হিসেবে মনে করছেন, নাকি গণতন্ত্রকে তাঁরা লক্ষ্য হিসেবে ভাবছেন। কিন্তু তাঁদের অতীত কর্মকা- প্রমাণ করে না, তারা গণতন্ত্রকামী। যদি তাই হবে তবে দু’দফা ক্ষমতায় থেকেও গণতন্ত্র চর্চা দূরে থাক, সংসদকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বানিয়ে একক কর্তৃত্বে দেশে অগণতান্ত্রিক ধারাকে চালু রেখেছিলেন। জন্ম যার ক্ষমতায় আসীন থাকা উর্দিধারীর হাতে, তার কাছে গণতন্ত্রের সবক নেয়া মানেই তো জংলী আইনের আবরণে ঢাকা গণতন্ত্রকে ধারণ করা। জামায়াতে ইসলামী নামক গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী দলকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় বসে তাঁরা যে ‘গণতন্ত্র’(!) দেখিয়েছেন, তাতে গণতন্ত্র বিকৃত হয়ে দলতন্ত্রে, রাজকারতন্ত্রে, পাকিস্তানী ভাবচেতনায় পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র নয়, লুটপাটতন্ত্র, খুনতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হয়। যার নমুনা ২০০১ সাল হতে জনগণ দেখেছে শুধু নয়, ভুক্তভোগীও। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সক্রিয়বিরোধী এখনও জামায়াত। তাদের বিরোধিতা যে কতটা ভয়াবহ, কতখানি নৃশংস হতে পারে, সে তো আমাদের জানা ইতিহাস। যা ১৯৭১ পরবর্তীকালে ২০১৩ সালেও দেখেছে দেশবাসী। এই জামায়াতীরা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি যে নৃশংস আচরণ করেছে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং মাঝে মধ্যে বাংলাদেশেও তাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার যে প্রবণতা, তা স্পষ্ট করে যে, জামায়াত অগণতান্ত্রিক শক্তি। এই গণতন্ত্রবিদ্বেষী দলকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন মানেই তো নৈরাজ্য, নাশকতা, আলবদরীয় কায়দায় মানুষ নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালানো। বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়ে জামায়াত যদি আবার ক্ষমতায় আসে, তখন গণতন্ত্র হবে স্বৈরতন্ত্র; যুদ্ধাপরাধীরা পুষ্পমাল্য পরিধান করে কারাগার থেকে বেরুবে, বাংলাদেশ পরিচালিত হবে পাকিস্তানী চেতনা ধারায়। জামায়াত কখনও গণতন্ত্রের পথ মাড়ায় না, হাঁটা দূরে থাক। বিএনপি যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসের কথা আবারও জোর দিয়ে বলে, তবে তাদের উচিত হবে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার প্রমাণ দেয়া। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা। মওলানা ভাসানীর মতো নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েও যখন সাড়া পায়নি, প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েও যখন জনগণের সহযোগিতা পায়নি, তখন বুঝতে হবে, তারা ভুল পথে ভুল করে ভুলের বোঝা নিয়ে হাঁটছে। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সব কূল হারিয়ে বিলাপ-প্রলাপ করা সঙ্গত হলেও তা দেশ ও জাতিবিরোধী কেন হবে? পথ হারিয়ে লক্ষ্য ভুলে বিএনপি ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি শুরু করতে যাচ্ছে, তা বুমেরাং হতে বাধ্য। কারণ দেশে আন্দোলন করার কোন পরিস্থিতি নেই। জনজীবনে এমন কোন অবস্থা ঘটেনি, যে কারণে জনগণ বিদ্যমান শান্তি, স্বস্তির পথ ছেড়ে ধ্বংসের গর্জনে নিজেদের অর্জনকে ধূলিসাত করবে। পাকিস্তান নামক দেশটির প্রতি বিএনপির সহমর্মিতা পুরনো। যে কারণে পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে পুনর্বাসন শুধু নয়, পাকিস্তানপন্থীদের সর্বত্র ঠাঁই দিয়েছেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর উত্তরসূরিরা পাকিস্তানকে আদর্শ মেনে বাংলাদেশকে সেই পথে পরিচালিত করার জন্য যে সক্রিয়; তা তাদের কর্মকা-ই বলে দেয়। বিএনপি নেত্রী ও তদীয় পুত্রসহ গয়রহরা যে বেসামাল হয়ে পড়েছেন, তাই তাঁরা এখন কি বলতে কি বলছেন, বুঝতে পারছেন না। তাঁদের সব বাতচিত একাত্তর দেখা বাঙালীর কাছে পাকিস্তানী আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নয়।
×