ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশ গুপ্ত

যে উদারতায় বাংলাদেশের উজ্জ্বলতা

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

যে উদারতায় বাংলাদেশের উজ্জ্বলতা

বাংলাদেশ সরকার কিংবা দেশ শাসনে নিয়োজিত দল বা নেতৃত্বের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে যাঁরা বাংলাদেশকে অপমান করেন তাঁদের বলি চোখ মেলুন। কথায় কথায় নেগেটিভ বাংলাদেশ আর ইদানীংকালের এক রোগ মানবাধিকারের কথিত চর্চা ছাড়ুন। এই দেশ, এদেশের জনগণ আসলে কি চায়, কি তাদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করুন। এ লেখা যখন লিখছি পাকিস্তানের ভয়াবহ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি চট্টগ্রামের মানুষ, দেশের বিখ্যাতজনদের পরিবর্তে আমার শহরের মানুষদের আমি ভাল চিনি, ভাল জানি। সামাজিক নেটওয়ার্কের এই কালে কিছুই গোপন বা লুকানো থাকে না। ছবিতে দেখলাম পাকিস্তানের শিশু হত্যার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসা মানুষদের কারও নাম প্রদীপ, কারও শিলা, কারও রোজী সেন, কারও নাম সুনীল। রাশেদ হাসান বা বালাগত ভাইদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। এরাই তো পাকিস্তানী বর্বরতার টার্গেট। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ অবধি যাবতীয় প্রগতিশীল কর্মকা- আর ভাল কাজের বিরুদ্ধে লেগে থাকা পাকিদের ঘোর দুশমন সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুরা। ভারতবিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িকতা পুঁজি করে চলা পাকিরা কি এখান থেকে কিছু শিখবে? সামাজিক নেটওয়ার্কে বেলাল বেগ মন্তব্য করেছেন, পাঠ গ্রহণের মন মানসিকতা বা ইচ্ছে কোনটাই পাকিস্তানের নেই। এটা মিথ্যা নয়। তাদের আচরণ ও মানসিকতা এখনও প্রাগৈতিহাসিক যুগের। পাকিস্তানীদের মন ও চিন্তায় বাংলাদেশ হারানোর বেদনা যে ক্রোধের জন্ম দিয়ে রেখেছে এখনও তা ঘোচেনি। তারপরও আমরা আমাদের জনগণ সে দিকে খেয়াল না করে নিজেদের দায়িত্বে মাঠে বা রাস্তায় নেমে এসেছে। একদল মানুষ ও কিছু মিডিয়া যাদের পাকিবন্দনা আর প্রকারান্তরে সে দেশের প্রতি দুর্বলতা প্রায়ই প্রকাশ্য আজ তারা এ ঘটনাকে যতই মানবিক বলে উল্লাস করুক আসলে এটা তাদের গালে চপেটাঘাত। এরা বাংলাদেশে কোন ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তার আসল-নকল বা সত্য-মিথ্যার পরিবর্তে সরকারের সমালোচনা আর নিন্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইদানীং আর একটা বিষয় দেখে দুর্ভাবনা বাড়ে, কোন এক অজ্ঞাত কারণে এরা মুক্তিযুদ্ধ ও এর বিরুদ্ধ উভয় শক্তিকে সমানভাবে প্রচার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কাদের মোল্লার ফাঁসি থেকে গোলাম আযমের লাশÑ সব কিছুতেই সহানুভূতি জাগানোর অপচেষ্টা আছে। একজন বয়স্ক মানুষের প্রতি সদয় হবার ভান করা আর একাত্তরে তাঁর ভূমিকা মনে করিয়ে দেয়ার তফাৎ বুঝতে না পারলে কিসের কি? সাংবাদিকতার নামে আজকাল এই অপপ্রক্রিয়ার জনকরা কিন্তু এককালের বাম বা আদর্শবাদী মানুষ। এরা এখন এমন ভাব করেন যেন বাংলাদেশে মানবাধিকার সুশাসন কিংবা ভাল বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমার এক জাতীয়তাবাদী বন্ধু আমাকে প্রায়ই জানান দেন দেশের এই আয়-উন্নতির সঙ্গে সরকারের নাকি কোন সম্পর্ক নাই। উদাহরণ দিয়ে বলেন, মিয়ানমারেও উন্নতি হচ্ছে সেটা কি গণতন্ত্রের ফল? হাসব কি কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। পদ্মা সেতুর কলঙ্কের দায় সরকারের, রানা প্লাজা ধসের দায় আওয়ামী লীগের, ঢাকার রাস্তায় কিছু হলে দায় শেখ হাসিনার আর প্রবৃদ্ধি বাড়লে বা আয় বাড়লে, দেশ ভাল চললে তার জন্য বাহবা পাবে অন্য কেউ? এদের আমরা চিনি জানি। এদের গাত্রদাহের কারণও বুঝি। কিন্তু যারা একবার ড. ইউনূসকে সামনে এনে, একবার জেনারেল মইন-উ আহমদকে সামনে এনে বা সুশীল নামের কুশপুতুলদের নিয়ে আমাদের জাতিকে ঝামেলায় ফেলার খেলা খেলেন তাদের বুঝি না। পাকিদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটার কারণে আমরা সবাই স্তম্ভিত ও বিষাদগ্রস্তÑ সবাই আজ শোকার্তও বটে। সে শোক শক্তিতে পরিণত হোক আর কোনদিন না ঘটুক এটা আমাদের সবার চাওয়া। পাশাপাশি এটাও কি জরুরী না এ জাতীয় রাজনীতি বা প্রক্রিয়া দেশে যাতে ছায়া না ফেলে তা নিশ্চিত করা? কে করবে এই কাজ? মিডিয়া না জনগণ? আমাদের মিডিয়ার যে অংশটি আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধিতার আবরণে পাকিদের সমর্থক তাদের আচরণ দেখুন। কাদের মোল্লার ভি চিহ্ন দেখানোর ব্যাপারে যতটা আগ্রহ তার সিকিভাগও নেই একাত্তরে এদের ভূমিকার নবায়নে। এরা আমেরিকা বা পশ্চিমাদের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে ফেনা তুললেও জানে না দুনিয়ার কোন্ দেশ কিভাবে কি আইন করে নিজেদের ইতিহাস ও অতীতকে সামলে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা মানুষের জীবন-ইজ্জত হারানোর মতো বিষয় নিয়েও আজ খেলছে এরা। মিডিয়া প্রশ্রয় না দিলে খুনী-দালালদের ছেলে-কন্যা বা আত্মীয়রা এসব কথা বলার সাহস পেত? সেদিন দেখলাম, এক যুদ্ধাপরাধী মেয়ের আহাজারি তার পিতা কোথায় ঘুমাবে, কে তাকে বিছানা করে দেবে, কোথায় প্রার্থনা করবেÑ এসব নিয়ে স্পর্শকাতর কথাবার্তা প্রচার হচ্ছে। কোথায় গেল একাত্তরে নামাজরত মানুষের ওপর নির্যাতনের খবর? কোথায় গেল মানুষের লুঙ্গি খুলে ধর্ম বা পরিচয় বের করার উলঙ্গ প্রবণতার খবর? একইসঙ্গে এই কথাগুলোও মনে করিয়ে না দিলে মানে দাঁড়ায় এরা অতীতের কথা ভুলে আজ দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে নেমেছে। এমন বাস্তবতায়ও এ দেশের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানীদের আবারও দেখাল আমরা কতটা সংবেদনশীল। অন্ধদের বলি চোখ মেলুন বাংলাদেশের ভাল দিক ও কাজগুলোর কথা বলুন। যাঁরা আমাদের দেশ ও জাতির নেগেটিভ দিক খুঁজে হয়রান, যাঁরা ভাবেন আমরা অন্ধকারে নিমজ্জিত, যাঁরা ভাবেন মুক্তবুদ্ধির মানুষরা কেবল অতীতমুখী কিংবা একাত্তরের প্রতিশোধ নিতে আগ্রহী সেসব নব্য সুবিধাবাদী সমালোচক ও নিন্দুকদের বলি, চোখ মেলে দেখুন। আজ সারাদেশে মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা পাকিস্তানের বর্বরতম শিশু হত্যার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছেন। তারা একাত্তরের জয়-পরাজয় বা ভূমিকার কথা মনে রাখেননি। এখানেই আমাদের উজ্জ্বলতা। আমাদের দেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মায়া আর ভালবাসার কাঙ্গাল। ভালবাসা, প্রীতি বা বেদনার মতো মৌলিক বিষয়গুলো এখনও সচল। পাকিস্তানের উগ্র একরোখা হিংসাত্মক রাজনীতি এখনও আমাদের কাছ থেকে পাঠ নিতে পারে। আমরা সবার জন্য কাঁদি, ভালবাসায় আকুল হতে জানি। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে উন্মাদনা নেই, আছে : আমি নয়ন জলে ভাসি। মানবতার জন্য বাংলাদেশের কান্না দেখে শেখো পাকিস্তান। এখনও তোমার অনেক শেখার বাকি।
×