ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে খালেদা জিয়া শোনালেন ইতিহাসের অভিনব কথা

স্বাধীনতা যুদ্ধের রণাঙ্গনে আওয়ামী লীগের কোন ভূমিকা ছিল না

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

স্বাধীনতা যুদ্ধের রণাঙ্গনে আওয়ামী লীগের কোন ভূমিকা ছিল না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, আমরা এবার অস্ত্রের মোকাবেলায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামব। সেই আন্দোলনে বর্তমান সরকার তাসের ঘরের মতো ভেসে যাবে। সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপ্লব করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এর কারণ, জাতির সেই ঘোর সঙ্কটকালে তারা ইতিহাস-নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখে তারা যুদ্ধ করেনি। তারা ইতিহাস নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে ভারতে আশ্রিত জীবন কাটিয়েছে। এ কারণে, তারা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়েও সত্যিকারের সাহস ও দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে পারেনি। জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও আক্রান্ত জনগণকে রক্ষার চেয়ে তারা নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথাই বেশি ভেবেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ দলীয় যুদ্ধ ছিল না । এটা ছিল জাতীয় জনযুদ্ধ। তারা এখন নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে স্বাধীনতা যুদ্ধকে দলীয় সম্পদে পরিণত করতে চায়। কিন্তু কখনও তা সম্ভব হবে না। রবিবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, একটি দল সব সময় দাবি করে, তারা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ সংঘটিত করেছে ও নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের দাবি যে কতটা অসার তা এখন সেই দলভুক্ত লোকদের লেখা বই-পত্র এবং বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু সত্য কথা কেউ বললে তারা তার সঠিক ও তথ্যভিত্তিক জবাব না দিয়ে গালাগাল শুরু করে। তাদের ফরমায়েশী ইতিহাসের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও তারা রাজাকার ও পাকিস্তানের চর বলে লেবেল এঁটে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। গালাগালি ও হুমকি দিয়ে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না। সকলেই জানেন যে, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত তদানীন্তন মেজরিটি পার্টি পাকিস্তানী সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তারা সচেষ্ট ছিল। এই আলোচনার আড়ালে যে সৈন্য ও অস্ত্র আনা হচ্ছিল, তা জেনেও তারা স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়নি। বাংলাভাষী সামরিক অফিসারদের দেয়া স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব তারা অগ্রাহ্য করেছিল। আর তাই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে হরতাল ছাড়া আর কোন কর্মসূচী তারা ঘোষণা করতে পারেনি। সে প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। নিরস্ত্র জনগণের ওপর সামরিক আক্রমণ কতটা নৃশংস ও ভয়াবহ হতে পারে, সে কথা কল্পনা করার শক্তিও তাদের ছিল না। তাই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে অস্বীকৃতির পাশাপাশি তাদের সর্বশেষ পরামর্শ ছিল নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর। আক্রমণের মুখে কোন দিকনির্দেশনা না দিয়ে পালিয়ে যাওয়া কিংবা আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। তাদের এই ব্যর্থতার পটভূমিতে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেছিলেন। হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক জানজুয়াকে হত্যা ও বাকিদের বন্দী করেছিলেন। বেতার মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। তাঁর ঘোষণার মাধ্যমেই বিদ্রোহ উন্নীত হয়েছিল বিপ্লবে। প্রতিরোধযুদ্ধ উন্নীত হয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। তাঁর সেই কণ্ঠ দেশবাসী শুনেছে এবং সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। আর কারও সেই সাহস হয়নি। এটাই বাস্তবতা। এটাই ইতিহাসের অমোঘ সত্য। খালেদা জিয়া বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এমন একটি নির্বাচনের পন্থা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বের করার আহ্বান আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছি। এর মধ্যে প্রায় এক বছর চলে গেছে। মানুষের অবস্থা ও দেশের পরিস্থিতি দিন-দিন খারাপ হচ্ছে। সকলের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমাদের শান্তিপূর্ণ আহ্বানে তারা সাড়া দেয়নি। তাই আমাদের বসে থাকার আর কোন উপায় নেই। দেশের জনগণ আন্দোলন চায়, পরিবর্তন চায়। তারা তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা ভোট দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেজন্য তারা বিএনপি ও ২০ দলের প্রতি আন্দোলন করার জন্য প্রতিনিয়ত আহ্বান জানাচ্ছে। আমি যেখানেই যাচ্ছি, দলে দলে লোক এসে আন্দোলনের দাবি জানাচ্ছে। কাজেই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অচিরেই আমাদেরকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। আমরা অস্ত্রের মোকাবিলায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামবো। আমাদের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক, জনগণের আন্দোলন। জনগণের সেই আন্দোলনে স্বৈরাচারী, অবৈধ সরকার তাসের ঘরের মতো ভেসে যাবে ইনশাআল্লাহ্। খালেদা জিয়া বলেন, আজ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাচ্ছি অভিবাদন। প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় যেসব জাতি আমাদের সে সময় সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন যুগিয়েছে, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম বীর অধিনায়ক জিয়াউর রহমানের প্রতি আমি এই উপলক্ষে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তিনি যথাসময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্বাধীনতাযুদ্ধে উন্নীত করেছিলেন। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে বৈধতা দিয়েছিলেন। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, মুষ্টিমেয় বিরোধিতাকারী ছাড়া, দল-মত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সাফল্যকে দলীয়করণ করার অপচেষ্টা শুরু হয়। সেই হীন উদ্দেশ্যেই স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসকেও বিকৃত করার প্রক্রিয়া চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধকে দলীয়করণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আপনারা অতীতেও দাঁড়িয়েছেন, সব সময় দাঁড়াতে হবে। একটি বিশেষ দল স্বাধীনতাযুদ্ধের মনগড়া ইতিহাস বলে চলেছে। সেই খ-িত ও বিকৃত ইতিহাসকে শুদ্ধ করে বলতে গেলে কিংবা একটু চ্যালেঞ্জ করলেই তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কথা বললেও তারা তার সুষ্ঠু জবাব না দিয়ে শুরু করে দেয় অশ্লীল গালিগালাজ ও হুমকি-ধমকি। এর কারণ, আর তাই তারা ইতিহাসের সত্যের বদলে আবেগকে আশ্রয় করে নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্বলতাকে ঢাকতে চায়। খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেটের অন্তর্গত বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কমান্ডারেরা বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে মুক্তিফৌজ গঠন, সেক্টর বিভাজন এবং সর্বাধিনায়ক নির্ধারন ও সেক্টর কমা-ারদের দায়িত্ব ও যুদ্ধ-এলাকা বণ্টন করা হয়। সেই বৈঠকেই রেজলিউশন নেয়া হয়, নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে খুঁজে বের করে তাদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতে হবে এবং সেই সরকারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার আহ্বান জানাতে হবে। এর অর্থ কী? স্বাধীনতার যে ঘোষণা তখনকার নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতাদের দেয়ার কথা ছিল, সেটা তারা দিতে পারেননি। সেটা দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। অর্থাৎ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরুর নির্দেশনা তারা দিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও অধিনায়ক ঠিক করার কাজটিও তারা করতে পারেননি। এটাও সামরিক কমা-ারেরা নিজেরাই করেছেন। এবং সেটা করেছেন প্রবাসী সরকার গঠনের আগেই। একটা প্রবাসী সরকার যে গঠন করতে হবে, সেই তাগিদটাও তারা নিজেরা বোধ করেননি। তাগিদটা এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের কমা-ারদের কাছ থেকে। সেই অনুযায়ী ১০ এপ্রিল আগরতলায় প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়ার অন্তর্গত বর্তমান মেহেরপুর জেলার সীমান্ত-সংলগ্ন আমবাগানে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সেই সরকারের অভিষেক, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আনুষ্ঠানিক উপস্থাপনা ও সালাম গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাহস ও দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের এসব ব্যর্থতা ও দুর্বলতা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে এসব দুর্বলতার কারণেই স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তারা এতটা স্পর্শকাতর। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, আওয়ামী লীগ রণাঙ্গনের লড়াইয়ে অংশ নেয়নি বলেই মুক্তিযোদ্ধাদের কখন আন্তরিকভাবে সম্মান ও মর্যাদা দেয়নি। স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়ের লগ্নে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তারা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী কিংবা প্রধান সেনাপতি অর্থাৎ চীফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল আবদুর রবের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারেনি। তাদের আস্থাভাজন ডেপুটি চীফ অব স্টাফ এ. কে খোন্দকারকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। সেই আস্থাভাজন ব্যক্তিটিও যখন স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস ও পূর্বাহ্নের প্রস্তুতিহীনতা সম্পর্কে কিছু সত্য কথা বলে ফেললেন, তখন তাকেও ‘পাকিস্তানের চর’ আখ্যা দিতে তারা দ্বিধাবোধ করেনি। এই হলো তাদের চরিত্র। স্বাধীনতার পরপরই ক্ষমতাসীনরা মুক্তিযুদ্ধের বীর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ. জলিলকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। ভিন্নমত পোষণের দায়ে ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার রক্তে তারা তাদের হাত রঞ্জিত করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পর্যন্ত তারা তৈরি করতে রাজি হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন জিয়াউর রহমান শুরু করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের প্রামাণ্য উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য তিনিই ইতিহাস প্রকল্প গ্রহণ করেন। কোন দলীয় লোকের মাধ্যমে নয়, দেশের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, গবেষক ও লেখকদের তিনি এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী দলের সরকারই আপনাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করে। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান ও স্মারকসমূহ সংরক্ষণের প্রকল্পও আমরা নিয়েছিলাম। খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এদেশে অনেক রাজনীতি হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমরা তা কখনও করব না। মুুক্তিযোদ্ধারা দলীয় রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হতে চান না। তারা কারও করুণা ও ভিক্ষা চান না। বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মাধ্যমে বিপুল রক্তপাতে ও ত্যাগে তারা ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়ের পতাকা। এই ভূখ- ও রাষ্ট্র তারা উপহার দিয়েছেন আমাদের। মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম বীর অধিনায়ক, যিনি রণাঙ্গনে কয়েকটি সেক্টরের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্রিগেডের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই জিয়াউর রহমান বীরউত্তম প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের জাতীয় উপলব্ধি ও সংহতির কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সে কারণেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত এই দল মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্রে রেখে ইস্পাত কঠিন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনে সব সময় সচেষ্ট। অপরদিকে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ সব সময় জাতির মধ্যে বিভেদ-বিভাজন, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বিভক্তি ও হানাহানি সৃষ্টিতে তৎপর। খালেদা জিয়া বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, কোন মানুষই ত্রুটি-বিচ্যুতি, ভুল-ভ্রান্তি ও ব্যর্থতা থেকে মুক্ত নয়। কেউ-ই সকল সমালোচনার উর্ধে নয়। এ সত্যকে মেনে নিয়েই আমরা সরকারে থাকতে আমি নিজে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, জাতির এই পাঁচ কৃতি-সন্তানকে জাতীয় নেতা হিসাবে মর্যাদা দিয়ে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা হোক। দুর্ভাগ্যের বিষয় এতে তাদের সম্মতি মেলেনি। পক্ষান্তরে তারা শহীদ জিয়া ও অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় একের পর এক আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। শহীদ জিয়ার নাম-নিশানা মুছে দেয়ার জন্য সর্বপ্রকার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। ফলে আমাদের জাতীয় ইতিহাস প্রশ্নে কাক্সিক্ষত ন্যূনতম জাতীয় সমঝোতা স্থাপন সম্ভবপর হয় নাই। আমি আজ সকলের উদ্দেশে বলতে চাই যে, দেশের মানুষ যদি কাউকে সম্মান দিতে না চায়, তাহলে আইনজারী করে কিংবা রাষ্ট্রীয় বা দলমন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়ে তাকে সম্মানিত করা যায় না। আর জনগণের হৃদয়ে যদি কারও জন্য শ্রদ্ধার আসন পাতা থাকে, তাহলে হাজারো চেষ্টা করেও তাঁর নাম মুছে দেয়া যায় না। খালেদা জিয়া বলেন, যতদিন এই দেশ থাকবে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন মানুষের অন্তরে। অমলিন থাকবে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের নাম। যারা সেই নাম মুছে দেয়ার অপচেষ্টা করবে, তারাই মানুষের ঘৃণা কুড়াবে। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তিনি বলেন, আগামীতে জনগণের সমর্থনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হাতে পেলে জাতীয় বিনির্মাণ ও পুনর্গঠনে মুক্তিযোদ্ধারা থাকবেন সামনের কাতারে।নতুন তালিকা প্রণয়নের নামে যে জঘন্য জালিয়াতি ও দলীয়করণের আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তা পরিশুদ্ধ করা হবে। প্রকৃত কোন মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে থাকবে না। কখনও কোন কারণে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কারারুদ্ধ হলে কারাগারে তার জন্য বিশেষ মর্যাদা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে রিজার্ভ সিট রাখার অথবা সুবিধাজনক স্থানে পৃথক একটি মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেব। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সস্তা ও আবেগাশ্রয়ী রাজনীতি চলতে থাকবে, আর মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করবেন, রিকশা চালাবেনÑ এই ভন্ডামী আর চলতে দেয়া যায় না। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। বৈধ কোন গণতান্ত্রিক সরকার নেই। গণতন্ত্র, সুশাসন, সুবিচার, জনগণের অধিকার, সমৃদ্ধির জন্য, দূরদেশীদের জুলুম-অত্যাচার-হত্যাকান্ড থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। সেই সব অর্জন এই স্বাধীন দেশে আজ আবার লুণ্ঠিত। আমরা রক্ত দিয়ে গণতন্ত্র এনেছিলাম, ভোটের অধিকার কায়েম করেছিলাম। আজ গণতন্ত্র নেই। ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি এক নির্মম প্রহসন করা হয়েছে। ন্যায়বিচার ও সুবিচার হরণ করা হয়েছে। বিচারের বাণী আজ নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। জিনিসপত্রের দামের সীমাহীন ঊর্ধগতিতে মানুষ দিশেহারা। মাদক-সন্ত্রাস-প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষা ও তারুণ্য আজ বিপথগামী। সন্ত্রাস আজ সর্বব্যাপী। খালেদা জিয়া বলেন, গুম-খুন-উৎপীড়নে প্রতিটি জনপদ আজ রক্তাক্ত। জনগণের নিরাপত্তার জন্য গঠিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে খুনী-ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে যথেচ্ছ দলীয়করণে। সবখানে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। শেয়ার বাজার ও ব্যাংকগুলো লুট হয়ে গেছে। শাসক দলের লোকেরা মাত্র এক বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে বিদেশে। সুইস ব্যাংকের ভল্টগুলো ভরা হচ্ছে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত শুষে নেয়া অর্থে। দায়মুক্তি দিয়ে কুইক রেন্টালের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ হলো। তবুও মানুষ অন্ধকারে। বিদ্যুত-গ্যাস-পানির জন্য হাহাকার। সুন্দরবন আজ শাসক তস্করদের লোভ ও ষড়যন্ত্রে বিপন্ন। খালেদা জিয়া বলেন, মাদরাসার গরিব এতিম শিক্ষার্থী, পিলখানার চৌকস সেনা অফিসার ও প্রতিবাদী সহস্র তরুণের তাজা রক্তে সরকারের হাত আজ রঞ্জিত। হামলা, মামলা, উৎপীড়নে তারা সব প্রতিবাদ, জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্রকে পর্যুদস্ত করে রাখতে চাইছে। ভিনদেশী হানাদারদের পথ বেছে নিয়েছে আজ স্বদেশী দুঃশাসক হানাদাররা। দেশের এই করুণ পরিস্থিতিতে, দেশবাসীর এই চরম দুঃসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা কি চুপ করে বসে থাকতে পারেন? নিশ্চয়ই না। আপনাদেরকে প্রতিবাদ করতে হবে, আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। আপনারা জানেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত। আজ সেই ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহ সংঘটিত করার সময় এসেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, আমাদের দাবি খুব সামান্য। এদেশে গত ৫ জানুয়ারি কোন ভোট হয়নি। ভোট ছাড়া কোন সরকার বৈধ হতে পারে না। এভাবে বিনা ভোটে না-কি তারা গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা করেছে! আসলে সংবিধান নয়, গণতন্ত্র নয়, তারা রক্ষা করেছে তাদের ক্ষমতাকে। আর কেড়ে নিয়েছে জনগণের সকল অধিকার। এই প্রহসন করার উদ্দেশ্যেই তারা খেয়ালখুশিমতো আগেই একতরফাভাবে সংবিধান তছনছ করে ফেলেছিল। তারা মনে করে তাদের এসব ধূর্ত অপকৌশল দেশ-দুনিয়ার মানুষ কিছুই বোঝে না। এই পরিস্থিতিতে আমরা একটি সত্যিকারের নির্বাচন চাইছি। যে নির্বাচনে ভোটাররা নির্বিঘেœ ও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভোট দিতে পারবে। যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারবে এবং সকল দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে। কেউ ক্ষমতাসীন থেকে আর কেউ ক্ষমতাহীন থেকে নির্বাচন করবে, সেটা হতে পারে না। আর নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ এগুলোকে দল-নিরপেক্ষ অবস্থানে আনতে হবে। বক্তব্য রাখার আগে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা ক্রেস্ট ও প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করেন খালেদা জিয়া। ক্রেস্ট ও আর্থিক অনুদানপ্রাপ্তরা হলেনÑ মোশাররফ হোসেন, খুরশীদ আলম সেজু মিয়া, জিয়াউল হক বাবু, মতিউর রহমান মনি, মোঃ শাহজাহান, আবু ইউসুফ হাওলাদার, আব্দুল আজীজ, মোঃ রমজান আলী, আবুল কালাম ও মোঃ মোহন মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজীজ উলফাত। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেনÑ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল নোমান, শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক, এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ, কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখ। দুই ছাত্রদল নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ॥ ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আবু সাঈদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদারের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে বিএনপি। রবিবার বিএনপি কার্যালয় থেকে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
×