ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রাজনীতি অঙ্গনের কীর্তিমান পুরুষ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, আমৃত্যু সংগ্রামী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য প্রবীণ জননেতা আবদুর রাজ্জাকের আজ তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ষাটের দশকের দুরন্ত ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সংগঠক ও পঁচাত্তরউত্তর আওয়ামী রাজনীতির মধ্যমণি বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি আদর্শের মানসপুত্র বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুর রাজ্জাক প্রায় তিন মাস জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০১১ সালের এই দিনে চিকিৎসাধীন লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহছায়ায় যে ক’জন কীর্তিমান পুরুষ স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে আমৃত্যু নেতৃত্ব দিয়েছেন আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তাঁদের অন্যতম। নির্লোভ, নিরহঙ্কারী ও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুর রাজ্জাক ৭০ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে। তিনি স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক, দুই পুত্র নাহিন রাজ্জাক, ফাহিম রাজ্জাকসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, নেতাকর্মী ও গুণগ্রাহী রেখে যান। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুর রাজ্জাক তাঁর নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যে রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন, তা আমৃত্যু পালন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতোই আজীবন নির্লোভ ও সাদামাটা জীবনযাপন করে গেছেন তিনি। রাজনীতির মাঠ কাঁপানো, সারাদেশ চষে বেড়ানো সুঠামদেহী আবদুর রাজ্জাকের দেহে মরণব্যাধি লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছিল অনেক আগেই। শেষদিকে ভরাট কণ্ঠের তেজও তেমন ছিল না। এই মরণব্যাধিও তাঁকে দমাতে পারেনি শেষদিন পর্যন্ত। ষাটের দশকের মাঠ মাতানো ছাত্রনেতা, ছাত্রলীগের দু’বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও এদেশের প্রথম সারির প্রবীণ রাজনীতিবিদ ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। এই রাজনীতিকের জš§ ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট শরীয়তপুর জেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ইমাম উদ্দিন এবং মাতার নাম বেগম আকফাতুন্নেছা। তিনি ১৯৫৮ সালে ডামুড্যা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং পরে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৬৭ সালে এলএলবি পাস করার পর ১৯৭৩ সালে আইনজীবী হিসেবে বার কাউন্সিলে নিবন্ধিত হন। সাবেক পানিসম্পদ এই মন্ত্রীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের শুরু পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯৬০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫-৬৭ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক পরপর দুইবার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২-৬৩ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচনে বিনাপ্রতি™^›ি™^তায় সহ-সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাকশালের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৮-৮১ সাল পর্যন্ত পরপর দুইবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে বাকশাল গঠন করে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাকশালের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৯১-২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে তাঁকে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রয়েছে তাঁর। ওই সময় গঠিত মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও রূপকারও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারের (মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের একজন) দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই বীরযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষকও ছিলেন। স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবদুর রাজ্জাক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। নব্বই দশকের শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। আবদুর রাজ্জাক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা-গোসাইরহাট)। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবদুর রাজ্জাক ওই সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মন্ত্রী থাকাকালেই ১৯৯৭ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচী। আওয়ামী লীগ আজ সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আবদুর রাজ্জাকের কবরে পুষ্পার্র্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করেছে আলোচনা ও স্মরণসভা। মরহুমের বাসভবনেও (বাড়ি নং-৮, সড়ক নং-৭৬, গুলশান-২) মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। শরীয়তপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, আব্দুর রাজ্জাকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কোরানখানি ও দোয়া মাহফিল ছাড়াও প্রতিটি উপজেলা ও জেলা সদরে মরহুমের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, শোক র‌্যালি, আলোচনা সভা, কোরানখানি ও দোয়া মাহফিল এবং গণভোজের আয়োজন করা হয়েছে।
×